এই নিয়ে লিংকনের পচিশ নাম্বার মেয়ে দেখতে যাওয়া। এর আগে চব্বিশটি মেয়ে সে দেখে ফেলেছে । কিন্তু কোন মেয়েই তার পছন্দ নয়। চব্বিশ জনের মাঝে পাঁচজনকে পছন্দ হয়নি গায়ের রঙের জন্য। গায়ের রঙ কৃষ্ণ বর্ণের ছিলো বলে শুরুতেই রিজেক্ট করে দিয়েছে। তিনজনকে বাতিল করলো বেঁটে হবার কারনে। দাঁত উচু বলে দুইজনকে। মুখে ব্রনের কারণে তিনজনকে। একজনের চোখ সামান্য ট্যারা আর বাকীদের কোন না কোন সামান্য খুঁত ছিলোই।
পরিবারের চাপে পরে দুই বছর আগে লিংকন ঘোষণা দেয় বিয়ে করবে বলে। কাগজে বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে কিন্তু মাঝ রাস্তায় অনেক প্রস্তাব বাতিল হয় বংশ আর শিক্ষাগত যোগ্যতা, আরো নানাবিধ কারণে। তার মধ্যে বাছাই করা হয় এই পঁচিশ জনকে। আর এর মধ্যে চব্বিশ জনকে বাতিল করে শেষ পঁচিশ নাম্বার মেয়েকে দেখতে যাবে ঠিক করা হয়।
লিংকন একজন আর্মির মেজর। দেশ সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে অনেক বছর ধরে। দেখতে লম্বা চওড়া ফর্সা । যেকোন নায়ককেই হার মানানোর রুপ তার। বাড়িতে বাবা, ভাই আর ভাইয়ের বৌ রয়েছে। ভাইয়ের বউয়ের নাম মল্লিকা যে কিনা লিংকনের সমবয়সী এবং বন্ধুর মতন। ভাই একটি ব্যাংকে চাকুরী করে আর মল্লিকা একটি স্কুলে। বাবা অবসর প্রাপ্ত একজন শিক্ষক। প্রায় ত্রিশ ছুঁই ছুঁই লিংকনকে অনেক বছর যাবদ বিয়ের পিড়িতে বসানোর জন্য তার ভাই আর মল্লিকা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নাক উঁচু লিংকন যে মেয়েই দেখে না কেন সে মেয়েকেই বাতিল ঘোষণা করেন। তার ভাষ্যমতে আর্মি অফিসারের বউ হবে শিক্ষিতা সুন্দরী লম্বা আর সর্ব গুনসম্পূর্ণ। মল্লিকা মেয়ে দেখাতে একটা দিক ছাড় দিতে বলেছিলেন কিন্তু লিংকন মেয়ের ক্ষেত্রে কোন ছাড় দিতে রাজি না হওয়াই সবাই এমন মেয়ে পাওয়া বিরল বলে হাল ছেড়ে দিলেন। এই পঁচিশ নাম্বার মেয়ের সন্ধান আসে হঠাৎ করেই। আর ঘটক অনুরোধ করেছেন সরাসরি মেয়ে দেখার জন্য।
এদিকে লিংকনের ছুটি শেষ হয়ে আসছে তাই তাড়াহুড়া করে মেয়ে দেখতে যাবার দিনক্ষন ঠিক করা হয়। ভাই, বউদি আর দুজন বন্ধু মিলে মেয়ে দেখতে খুলনা যাবার পরিকল্পনা করে ফেলে। কুমিল্লা থেকে ঢাকা হয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে ওরা পাঁচজন রওনা হল । খুলনা পৌঁছে লিংকন আর মল্লিকা এক রিক্সায় যেতে যেতে মল্লিকা বলে উঠলো মানতেই হবে তোমার মেয়ে দেখা উপলক্ষ্যে আমাদের দেশের অনেক জায়গা দেখা হয়ে গেলো। লিংকনের বন্ধু আকাশ যে কিনা দুবছর আগে লিংকনের বাতিল করা এক মেয়েকে বিয়ে করে এক সন্তানের পিতাও হয়ে গেলো সে পাশ থেকে বলে উঠলো চিন্তা করো না বউদি আবারো তোমার দেবর মেয়ে বাতিল করবে আর আমাদের বন্ধুদের মাঝে কেউ না কেউ বিয়ে করে বাচ্চাকাচ্চার বাপ হয়ে যাবে।
লিংকন বলে উঠলো কি আর করার আমার যা ভালো লাগেনি তা তোদের ভালো লেগেছে। এরা কোনটাই আমার উপযুক্ত ছিলো না। পাশ থেকে মল্লিকা বলল এত ন্যাকামি করো না। শেষ পর্যন্ত তোমার কপালে কি জুটবে কে জানে।
কথা বলতে বলতে তারা মেয়ের বাড়িতে হাজির হলো। মেয়ের বাবা যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলো। তারা মেয়ে দেখে বের হয়ে যাওয়ার সময় মেয়ের বাবা রাতে খেয়ে যাওয়ারও অনূরোধ করলো। মেয়ে সম্পর্কে পরে জানাবে বলে তারা মেয়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো। কিছুদুর যাওয়ার পর লিংকনের দাদা শুভাশিস জানতে চাইলো মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিনা।
"আমারতো মেয়ে বেশ পছন্দ" বলে মল্লিকা আড় চোখে দেবরের দিকে তাকালো। তাতে বন্ধুরাও সায় দিলো।
মানতেই হবে যতগুলো মেয়ে দেখেছি এটাই বেস্ট কি বল দেবরজী বলে লিংকনকে মল্লিকা খোঁচা মারলো।
লিংকন আস্তে করে "হুম" বলল।
মল্লিকা এবার বেশ রেগে গিয়ে বলল "আদৌ কি তোমার বিয়ে করার ইচ্ছে আছে? যেমন মেয়ে দেখো না কেন তুমি বাতিল করে দাও। যেমন মেয়ে চাও তেমন তো পাওয়া যাবে না তারচেয়ে বরং কারিগর দিয়ে বানিয়ে নাও।" এই বলে সামনের দিকে হনহন করে হেঁটে গেলো।
লিংকন এবার মিনমিন করে বলে উঠলো "মেয়েটার সব কিছু ঠিকঠাক আছে শুধু নাকটা -------"
মল্লিকা অবাক হয়ে বলল "নাকটা কি হুম। মেয়েটা যখন হাসছিলো তখন গালে কি সুন্দর টোল পড়ছিলো সেটা কি চোখে দেখতে পাওনি?"
লিংকন বলে উঠলো "তা পরছিলো বটে কিন্তু নাকটা একটু চ্যাপা । আর একটু লম্বা হলে আরো বেশি সুন্দর লাগতো।"
-তাহলে এটাও কি বাতিল?
-আমি ভাবছি। আমাকে একটু ভাবতে দাও।
-ভাবো ভাবো নাকের কথা ভাবো। ভাবতে ভাবতে এই মেয়ের বিয়েও হয়ে যাবে। মল্লিকা ভেংচি কেটে শুভাশিসকে বলল "তোমার ভাইয়ের এই জীবনে বিয়ে করা হবে না। "
সেদিনের মতো তারা বাড়িতে ফিরে ঘটককে খবর দিলো যে বিয়ের পঁচিশ নাম্বার প্রস্তাবটি এনেছিলো। তাকে দিয়ে মেয়ের বাবাকে ডাকালো। মেয়ের বাবা আসার পর লিংকন বলল "আপনার মেয়েকে আমার পছন্দ শুধু নাকটা যদি আর একটু টিকালো হত তাহলে নজরকাড়া সুন্দরী হত।"
মেয়ে বাবা বলল "আমার মেয়েকে বুঝি তোমার পছন্দ হয়নি? ওর নাক বোঁচা বলে ছোট থেকে তাকে বুচি ডাকি কিন্তু আমার মেয়ে অনেক ভালো অনেক বুদ্ধিমতী। তাহলে কি বিয়ে বাতিল বলে ধরে নিবো ?" লিংকন বলল "আহা বিয়ে বাতিল হতে যাবে কেন আমি শুধু বলেছি নাকটা যদি আরো একটু লম্বা হত।" মেয়ের বাবা না বুঝে হা করে লিংকনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। লিংকন বলতে লাগলো সাইন্স আজ কত উন্নতি করেছে বোঁচা নাক লম্বা করা কোন ব্যাপার নাকি। আপনি ছোট একটা অপারেশন করিয়ে আপনার মেয়েকে আরো সুন্দর করে তুলতে পারেন।
মেয়ের বাবা "ভেবে দেখি" বলে তখনকার মতো চলে গেলেন।
প্রায় মাস তিনেক পর ।
লিংকন বসে আছে বুচির সামনে। চোখ ফেরাতে পারছে না। মল্লিকাকে খোঁচা মেরে বলল দেখেছো টিকালো নাকে ওকে পরীর মতো লাগছে? মানতেই হবে প্লাস্টিক সার্জারি না করালে এই মেয়ের সৌন্দর্য অর্ধেক থেকে যেতো। মনে মনে বউ হলে এমনি হবে যাকে দেখে সবাই হিংসা করবে বলে খুশী হয়ে উঠলো।
মল্লিকা, শুভাশিস আরো কয়েকজন মিলে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে চাইলো। কিন্তু আর্মি ক্যাম্প থেকে লিংকনের ডাক আসাতে কিছুদিনের জন্য বিয়ে পিছিয়ে দিতে হল।
"মেয়ে সুন্দর হবার পিছনে লিংকনের হাত আছে বলে সবাই প্রশংসা করতে লাগলো। মল্লিকা বলেছে পাত্রীকে নিখুঁত সুন্দরী করে তবে ছাড়লে । এইসব কথা চিন্তা করে মনে মনে খুশি হয়ে এইবার দিন তারিখ ঠিক করার জন্য বাবা, ভাইকে ফোন করে দিলো।"
কিছুদিন পর বিয়ে উপলক্ষ্যে লিংকন ছুটি নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হওয়ার জন্য কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলো ঠিক তখনি পিয়ন এসে তার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলল "আপনার নামে এসেছে খুব নাকি জরুরী।"
ব্যাগ গোছানো বাদ দিয়ে লিংকন চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো।
বাবা লিংকন,
একটা কথা জানানোর জন্য তোমাকে এই পত্র লেখা। তোমার সাথে আমার মেয়ের বুচির বিয়ে দিতে পারছিনা। আমার এক বন্ধুর পুত্র বিদেশের অনেক বড় ডাক্তার। ছেলে দেখতে খুব সুন্দর আর প্রচুর গুন রয়েছে। দেশে এসে কোন এক বিয়ের অনুষ্টানে আমার মেয়ে বুচিকে দেখে খুব পছন্দ করেছে। আমার বন্ধুও তার ছেলের জন্য আমাকে মেয়ে বিয়ে দিতে খুব জোর করছে। আমার মেয়ে বুচির ও ছেলেকে পছন্দ। তাই আর না করতে পারিনি। তাছাড়া এমন ছেলে পাওয়াও যায়না। আগামী রবিবার ওদের বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করা হয়েছে। সবাই বলছে বুচির নাক প্ল্যাস্টিক সার্জারি না করালে এমন ভালো ছেলে পাওয়া যেতো না। আমি বুচির জন্য এমন ছেলে পেলাম শুধু মাত্র তোমার জন্যে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক।
ইতি নীতেশ দাস
লিংকন একবার, দুইবার ,তিনবার করে বেশ কয়েকবার চিঠিটা পড়ার পর বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুজে একবারে বাচ্চাদের মতো করে কেঁদে ফেললো।
লেখক: রেটিনা অপরাজিতা
Comments (0)