আজ সকাল সকাল মিরুর মেজাজটা চড়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে মা'কে বকাঝকা করেছে সে।করবে নাই বা কেন? বহুবার মা'কে বলেছে তিনি যেন নিজের কাপড় নিজে না ধুয়ে মিরুকে দেয়।মিরু কাপড় ধুয়ে দেবে।সে না পারলে বাসায় সাহায্যকারী বিউটি খালা আছেন, উনি ধুয়ে দেবেন।অথচ আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মিরু দেখে সারা ঘরের জানালার পর্দা জায়গামতো নেই। মনে সন্দেহ হলে মিরু দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে সে যা ভেবেছে তা-ই। মা ফজরের নামাজ পড়ে এই সারা বাড়ির পর্দা খুলে ধুয়ে দিয়েছেন। তারপরই শুরু হয় মিরুর বকাঝকা।
- আপনাকে বারবার বলেছি নিজের কাপড় ধোবেন না।আর আপনি কি করলেন এইটা? আপনার হাঁটু ব্যাথার সমস্যা। কোন আক্কেলে এতগুলো কাপড় ধোয়ার চিন্তা করলেন? আমি আছি কি জন্য? আমার কথার কি কোনো গুরুত্ব নাই আপনার কাছে? নিজে কষ্ট পাবেন, আমাকেও দেবেন।ঠান্ডা পানি লেগে মাথা জ্বালা করবে।আবার মাথাব্যথায় কাতরালে আমি কিন্তু কাছেও আসব না।পা ফুলে ঢোল হলেও পা টিপে দেবো না।মনে রাইখেন!!
এতগুলো কথা একসাথে বলে মিরু হাঁপাচ্ছে। নিলুফা বেগম মাথা নিচু করে লজ্জিত মুখে বলে - যতদিন শরীরটা কুলায় একটু কিছু করতে দাও মা।যখন আর পারব না,করবো না।
- না মা, এইটা কোনো কথা না।আপনার এখন এরকম কায়িক পরিশ্রম করার বয়স না।সময় কাটানোর জন্য কিংবা টুকটাক হালকা কিছু কাজের কথা বলেছি করতে।তাই বলে এতগুলো কাপড় একসাথে?
- এর চেয়ে কত্তো ভারি ভারি কাজ করছি আগে! এখনতো আর পারিনা।যাও তো সোনা, ঠান্ডা পানি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করে বসো এবার।চেঁচামেচি করে গলা শুকাইছো। আমি আর কাপড় ধোব না, হলো তো!
- এই বল্লেন। দু'দিন পরেই ভুলে যাবেন জানি। নিলুফা বেগম হাসেন।প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন।
এই হলো মিরুর শাশুড়ি মা। মিরুর বিয়ের পর থেকে শশুর শাশুড়ি ওদের সাথেই থাকেন।মিরু তাদেরকে বাবা- মা বলে শুধু সম্বোধনই করে না, মনেপ্রাণে তা-ই ভেবে নিয়েছে সে।ওনারা ও নিজের মেয়ে ছাড়া মিরুকে অন্য কিছু ভাবতে নারাজ।মিরু বাবা মায়ের উল্টাপাল্টা বা শিশুসুলভ কাজে শাসন করে ভালোবেসেই। বাবা মকবুল সাহেব সকালের জগিং সেরে ঘরে ফিরলে মিরু তাঁর কাছে মায়ের বিচার দেয়। বাবা হেসে বলেন - ওটা তোমাদের ডিপার্টমেন্ট তোমারা সামলাও। আশাহত মিরু কপাল কুঁচকে বাবার দিকে তাকায়।মকবুল সাহেব একগাল হেসে মিরুর মাথা হাতিয়ে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করেন।
মকবুল সাহেব মিরুকে কোনোদিন নাম ধরে ডাকেন নি।বিয়ের পর থেকেই ওকে " মা" বলে ডাকেন।নিলুফা বেগম " ও মনি, ও সোনা" এভাবেই কথা বলেন। মিরুর কোনো ননদ নেই। মিরুর স্বামী শাহেদ মায়ের হাতের যে রান্নাগুলো খেতে পছন্দ করে,মিরু চেষ্টা করে সেগুলো মায়ের থেকে শিখে নিতে।মায়ের রান্নার ধরন রপ্ত করতে সদা সচেষ্ট মিরু।মাঝে মাঝে সে সবজি তরকারি কুটে বেছে মা' কে জিজ্ঞেস করে নেয় কোন মসলা কি পরিমাণ দিতে হবে।নিলুফা বেগমের চোখের ছানি অপারেশনের পর থেকে চুলার কাছে যাওয়া নিষেধ করেছে মিরু।তিনি ডাইনিং এ ফ্যানের নিচে বসে নির্দেশ দেন আর মিরু চেষ্টা করে মায়ের মতো করে রাঁধতে। রাতে ঘরের সমস্ত কাজ সেরে, সবার বিছানা ঠিকঠাক করে মিরু যায় মায়ের বিছানায়। অনেক রাত অবধি তারা গল্প করে।গল্প আসলে মা-ই করেন।মিরু চুপচাপ শোনে।মায়ের মাথায় বিলি কেটে দেয়, পা মাসাজ করে দেয়।নিলুফা বেগম তৃপ্ত হাসিহাসি মুখে তার যৌবনের রঙিন দিনগুলোর গল্প করতে খুব ভালোবাসেন।জীবনের অভাবের দিনগুলোর গল্প করতে গিয়ে চোখ ছলছল হয়।মিরুর চোখ এড়ায় না।মাকে সান্ত্বনা দিয়ে মিরু বলে - এগুলো সব অতীত মা।আজ তো আপনার কোনো অভাব নেই। তবে মন খারাপ করছেন কেন? নিলুফা বেগম চোখ মুছে মিরুকে কাছে টেনে নেন।
সেবার হঠাৎ করে মিরুর কি একটা পায়ের রোগ হলো।হাঁটা চলা একদম বন্ধ। পা ফুলে ঢোল। সাথে প্রচন্ড ব্যাথা। ডাক্তার, কবিরাজ কিছুই বাদ যায়নি। তবু রোগ সারে না। মকবুল সাহেব অস্থির হয়ে পড়লেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শেষে তিনি মিরুর পায়ে হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ে ফুঁ দেন। মিরু বিব্রত হয়।বাবাকে নিষেধ করে। মুরুব্বি মানুষ, যেন তার পায়ে হাত না দেয়।পাছে মিরুর পাপ হয়।মকবুল সাহেব আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন - মা রে, বাবার হাত মেয়ের পায়ে লাগলে কোনো পাপ হয় নারে বেটি! মা এসে মন খারাপ করে মাথার কাছে বসে থাকেন।মিরুকে বিছানায় উঠে বসতে সাহায্য করেন।ফোন করে কাকে কাকে যেন মিরুর জন্য দোয়া চান।মিরুকে সারাক্ষণ সাহস যোগান। আর মহান রবের কাছে মিরুর সুস্থতা চেয়ে কান্নাকাটি করেন।
এমনই শাসনে, বারণে, মায়ায় বাঁধা মিরুর সংসার।বছর সাতেক হলো বাবা চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, মিরুকে ছেড়ে। আর এই তো দু'বছর হলো মা ও নেই। মিরু এখনো সংসার করে। স্বামী সন্তানদের নিয়ে তার সুখের সংসার। কিন্তু প্রতিনিয়ত বুকের মাঝে কাঁটার মতো বিঁধে কি যেনো।রক্তক্ষরণ হয়।মিরু কাঁদে গোপনে। কেউ তা দেখে না।।
পরিশিষ্টঃ শশুর বাড়ি মাত্রই যে চিত্র আমাদের চোখের সামনে ফুঁটে ওঠে, এই গল্পটি তার ব্যতীক্রম।এখানে শশুর বাড়ির অত্যাচার, নির্যাতন নেই। তাই পাঠকের উঁহু, আহা সমবেদনা থাকবেনা। হয়ত পাঠক মন জয় করতে সক্ষম হবেনা গল্পটি। তবু পাঠক চাহিদার তোয়াক্কা না করে, ব্যাতীক্রম বাস্তব তথা চলমান স্রোতের বিপরীত একটি গল্প সাহস করে লিখে ফেল্লাম।ভালো লাগলে এমন আরো মিষ্টি ভালোবাসার বাস্তব গল্প লিখতে অনুপ্রাণিত হবো।ধন্যবাদ।
# কলমে - আরাফ সুলতান
Comments (0)