আমি আমার এক্স হাজবেন্ড এর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওদের বাড়িটা আজ খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে । সাজাবেই তো ! বিয়ে বাড়ি বলে কথা । চারদিকে আলো ঝলমল করছে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে ভেতরে ঢুকতে। আচ্ছা সাজ্জাদ কে দেখতে কেমন লাগছে ? সুন্দর ই লাগছে । শুনেছি সাজ্জাদ এর বউ নাকি ভারি সুন্দরী। আমার শাশুড়ি র পছন্দ আবার খুব ভালো।
সাজ্জাদ আর আমি একই অফিসে চাকরি করতাম । আমাদের ডিপার্টমেন্ট ও একই ছিল। এই জন্য সবসময়ই আমাদের একসাথে কাজ করা লাগতো। একসাথে কাজ করতে করতে কখন যে মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিল আমরা বুঝতেই পারিনি। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও খুব ভালো ছিল। দুই বছর ডেট করার পর আমরা ঠিক করি আমরা বিয়ে করবো। সাজ্জাদ এর ফ্যামিলি বলতে ওর মা আর ওর বড় আপু তনিমা । বড় আপুলন্ডনে স্বামী সন্তান নিয়ে ভালোই আছে।
সাজ্জাদ এর মায়ের এই বিয়েতে আপত্তি ছিল না । তনিমা আপু আমাদের কথা আগে থেকেই জানতেন। তনিমা আপুর আমাকে খুব পছন্দ। কুরিয়ারে কত গিফট পাঠাতেন আমার জন্য। সবসময় বলতেন, "নিহা তোমার মত মেয়ে সাজ্জাদ কিভাবে পেলো বলো তো। আমরা তো সাজ্জাদ এর জন্য এতো সুন্দর মেয়ে সারাজীবনেও খুঁজে পেতাম না। '
সাজ্জাদ তো তখন বলতো , এই তুমি আমার বউটার দিকে নজর দিও না।
"যাহ ! আপু । আমি এতো সুন্দর ও না । আপনি আমাকে বেশি ভালো বাসেন তো। "
কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো!
ওর মা ই পাপার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। পাপা ,মামুনি , আমার ছোট ভাই ইশান সবাই খুব খুশি। মামুনি আগে থেকেই জানতো আমাদের সম্পর্কের কথা। খুব ধুমধাম করে ই আমাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর সাজ্জাদ এর ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল। তনিমা আপু, আমার শাশুড়ি সবার ভালোবাসায় আমি তখন আকাশে ভাসছি। আমার মাঝে মাঝে মনে হত আমি যেন স্বর্গে আছি। কিন্তু ওই যে বেশি সুখ কারো কারো সহ্য হয় না । আমার ও হলো না।
মেজো কাকার সাথে পাপার জমিজমা নিয়ে অনেকদিন ধরেই সমস্যা চলছিল।এর ই জের ধরেই মূলত প্রতিশোধ নিতেই।মেজো কাকা আমার শাশুড়ি কে ফোন করে সব বলে দিলেন যে আমি পাপার পালক কন্যা। মেজো কাকা আমাকে খুব ভালোবাসেন । ইশান আর আমাকে কখনো আলাদা চোখ এ দেখেন নি। ওনি এমন করবেন আমি কখনোই ভাবিনি। আমার পাপা আর মামুনি র বিয়ের পনেরো বছরেও যখন কোনো সন্তান হচ্ছিল না তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা আমায় দত্তক নেয়। তখন আমার বয়স ছিল তিন বছর। আমাকে দত্তক নেওয়ার দু বছর পর ইশান হয়। কিন্তু তাতেও আমার প্রতি তাদের ভালো বাসা কমেনি । রিলেশন এর শুরুতে ই সাজ্জাদ কে আমি সব বলেছি। ওর এতে কোনো আপত্তি ছিল না। আমার শাশুড়ি মা সাজ্জাদ এর উপর প্রচন্ড রাগারাগী করলেন। পাপা কে ফোন করে ডেকে পাঠালেন। পাপা কে মিথ্যাবাদী, প্রতারক ,ঠক জোচ্চুর আর কত কিছু বললেন । পাপা শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। সাজ্জাদ ওর মা কে বুঝানো র খুব চেষ্টা করলো । আমিও মা র পা জড়িয়ে ধরে বললাম, "পাপার কোন দোষ নেই। পাপা বিয়ের আগে বলতে চেয়েছিলেন আমি আর সাজ্জাদ ই বলতে মানা করেছিলাম। আমাদের ভয় ছিল সত্যি জেনে আপনি যদি না করেন। যা বলার আমাকে বলুন মা।প্লিয পাপা কে কিছু বলবেন না। পাপা আমার কথা ভেবে কিছু বলে নি।"
আমার শাশুড়ি মা সাজ্জাদ এর উপর আরো রাগলেন, সাজ্জাদ তার থেকে এতো বড় ব্যাপার লুকিয়েছে। পাপা আমায় সাথে করে বাসায় নিয়ে আসলেন।এর পর ছয় মাস হয়ে গেল। ও বাড়ির কার ও সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।প্রথম প্রথম সাজ্জাদ অবশ্য ফোন করতো। কেমন আছো ? খেয়েছো ? ব্যস এতটুকু কথা। ও কিছু ওই ব্যাপারে বলতো না। আমিও জিজ্ঞেস করতাম না কিছু। অনেক বার তনিমা আপু র ফোন ট্রাই করেছিলাম। কিন্তু আপু ফোন ধরে নি। আমার কাছে সব এলোমেলো লাগতো। মাঝরাতে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠতাম। মামুনি ,ইশান ,পাপা সারারাত আমার কাছে বসে থাকতো। সাজ্জাদ এর সাথে আমার দেখা ও হয় নি । আর বিয়ের পর আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সংসার করবো সুন্দর করে। চাকরি টা থাকলেও ওর। সাথে দেখা হতো। এভাবেই সব চলছিল
হঠাৎ সাজ্জাদ একদিন ফোন করে বলল ," নিহা তোমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সাহস আমার নেই। আমি খুব চেষ্টা করেছি পারি নি। আমাকে মাফ করে দিও। ডিভোর্স পেপার পাঠাচ্ছি সই করে দিও।"
পাপা খুব চেষ্টা করলেন। নিজের আত্মসম্মান ভুলে আমার জন্য আমার শাশুড়ি মা র হাতে পায়ে ধরলেন। কিন্তু আমার শাশুড়ি মা কিছুতেই আমাকে রাখবেন না। তার এক কথা আমার মতো জাতকুলহীন ,কার না কার পাপের ফল ,জারজ সন্তান। এমন মেয়ে কে সে তার বাড়ির বউ রাখবেন না । আমাকে দেখলে নাকি তার ঘৃণা করবে। আমার হাতের খাবার খেয়ে ছে এতো দিন তাতেই নাকি তার বমি পায় এখন মনে করে।
আমি ওইদিন খুব কেঁদেছিলাম। পাপা কে জড়িয়ে। খুব কাঁদছিলাম।নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। পাপা কে বলছিলাম, "আমাকে জন্ম দিয়ে আমার বাবা মা আমাকে ফেলে দিয়ে গেছে এতে আমার দোষ কোথায়। আমি তো অপবিত্র নই। "
পাপা শুধু আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, "তুমি আমার মেয়ে। আর এটাই তোমার পরিচয়। নিজেকে তুচ্ছ মনে করো না। ওদের মনমানসিকতা ছোট ।ওরা তুচ্ছ মা ।"
পাপার কথা আমি মেনেছি। নিজেকে তুচ্ছ ভাবি নি।
আগামী সপ্তাহে আমার ফ্লাইট । সি়ংগাপুরে একটা বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে আমার চাকরি হয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তা আমার কাছ থেকে অনেক কিছু যেযন কেড়ে নিয়েছে ন তেমন আমায় অনেক কিছু দিয়েছেন। পাপা ,মামুনি, ইশান ওদের দিয়েছেন।এত সুন্দর মনের মানুষ গুলো আমায় দিয়েছেন। আমার কোনো আফসোস নেই। সাজ্জাদ এর প্রতি আমার কোন অভিযোগ ও নেই।
অনেকটা দূর হাঁটতে হাঁটতে চলে আসছি। বিয়ে বাড়ির সানাই এর শব্দ এখনো আসছে। আমি শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ভালো থেকো, সাজ্জাদ।
# ভালো_থেকো
লেখনীতে অর্থি আক্তার
Comments (0)