স্মার্ট হওয়া হওয়া ভালো। আবার কখনো কখনো অতিরিক্ত ওভার স্মার্ট হওয়া একেবারেই বিরক্তির কারন হয়ে দাড়ায়।
আমি আমাদের সহকর্মী হাসান ভাইয়ের কথা বলছিলাম। বিয়ে করেছেন এক বছর পূর্ণ হলো। একজন স্বামী তার বউকে কতো গভীর ভাবে ভালবাসতে পারে,এটা হাসান ভাইকে না দেখলে বুঝতাম না। মাঝে মাঝে তার বউ প্রীতি গুলো যখন আমাদের সামনে অফিসিয়াল জরুরী কাজের মাঝে উপস্থিত হয়,তখন খুব বিরক্ত লাগতো। গল্পের মাঝে বউ কিবা শশুর বাড়ির গল্প,হোটেলে নাস্তা করবো,সেখানে বউ আলাপ,ফিল্ডে গেলে কাজের চেয়ে বউ প্রসঙ্গে খাজুরা আলাপ, ইত্যাদি।
আমরা অন্যান্য সহকর্মীরা প্রায়ই বলতাম,মনে হয় আপনিই পৃথিবীতে একা বিয়ে করছেন। বউয়ের ভালবাসা ঘরে,বাহিরে দেখানোর দরকার কি?
আমাদের তীর্যক বাক্যবানে হাসান ভাই রাগ হতেন না।বরং হাসি মাখা মুখেই বলতেন,বিয়া তো করো নাই,একবার বিয়ার সাগরে জাহাজটা ভিড়াও,তখন বুঝবা বউ কি জিনিস!
হাসান ভাই কখনোই সাহিত্যিক ছিলেন না। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই কেনো যেনো তার আচার আচরনে আমি লক্ষ্য করেছি,তিনি দার্শনিক কিবা সাহিত্যমন্ডিত কিছু একটা হয়ে গেছেন। তার কথা বার্তা গুলোতে অন্তত আমি সেটাই বুঝতে পেরেছি। তবে তার সাহিত্যপ্রলাপ গুলো শুধুই বউ কেন্দ্রিক।
একদিন আমার আরেক সহকর্মী হাসান ভাইকে প্রশ্ন করলো--ভাই,হাতি পোষা আর বউ পোষা কি এক?
হাসান ভাই কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,এক কিনা জানিনা। তবে বউয়ের মন যদি একবার জয় করতে পারো,তাহলে হাতির সাথে বউয়ের তুলনা করাটা বৃথা। হাতির পেটের খোরাক প্রচুর কলাগাছ। আর নারীর খোরাক বেশি বেশি সাজুগুজু, টাকা পয়সা আর অতিরিক্ত বিলাসিতা। তুমি যদি একবার বউয়ের মনে জায়গা করে নিতে পারো,তাহলে এগুলো ছাড়াও বট তলায় পান্তা ভাত খেয়েও দাম্পত্য পার করতে পারো। তখন বউকে আর হাতির সাথে তুলনা করা মানানসই হয়না।
হাসান ভাই যে,তার বউয়ের মন জয় করে দিব্যি সুখেই আছেন,তার কয়েকটা খন্ড চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি----
#অফিস থেকে ঘোষনা হলো,তিন দিনের জন্য কুমিল্লার বাহিরে ফিল্ড অডিটে যেতে হবে। তার ভিতর হাসান ভাইও ছিলেন। বাহিরে বউ ছাড়া তিনদিন হাসান ভাই থাকবে,এটা তিনি শুনেই মাথায় আকাশ ভাঙ্গার মতো অবস্থা হলো!
ডেস্কে বসে দেখলাম হাসান ভাই মৃদু স্বরে ফুফিয়ে কাঁদছেন। ঘটনার সূত্রপাত জানতেই হাসান ভাই বলতে লাগলো-তোর ভাবি আমারে তিনবেলা নিজ হাতে ভাত খাওয়ায়,তোর ভাবির হাতে অসম্ভব একটা যাদু আছে,তার হাতের ছোঁয়া ছাড়া আমার পেটে ভাত যায়না। আর সেই আমি এখন বউ ছাড়া কেমনি বাহিরে থাকি, তু..ই বল?
অবশেষে হাসান ভাইয়ের এই বউভক্তের কাহিনি এরিয়া ম্যানেজারের কানে গিয়ে পৌঁছায়। এরিয়া ম্যানেজার হাসান ভাইয়ের বউ প্রীতি দেখে তাকে ফিল্ড থেকে অব্যহতি দেন।
#হাসান ভাই সহ আমরা চার জন বেলা এগারোটায় ক্যান্টিনে বসে সিঙ্গারা, চমুচা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ হাসান ভাই হাতে একটা চমুচা নিয়ে টেবিল থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে বউকে IMO তে ভিডিও কল দিলো। দূর থেকে যেটা আমরা অনুমান করলাম,সেটা হলো--হাসান ভাই ভিডিও কলে তার বউকে কল্পিতভাবে ভাগাভাগি করে চমুচা খাওয়াচ্ছেন এবং নিজেও খাচ্ছেন।
হাসান ভাইয়ের এই দৃশ্যটা অনেকে দেখেই আড়ালে হু হু করে হাসছিলেন।
#এরিয়া ম্যানেজার সোহেল সাহেবের ছোট মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে সোহেল সাহেব আমরা পুরো টিমকে দাওয়াত করেছেন। তবে পরিবার নিয়ে নয়। সবাই সিঙ্গেল। যথারীতি আমরা সবাই সিঙ্গেল সোহেল সাহেবের বাড়ি উপস্থিত হলেও একমাত্র হাসান ভাই তার বউ নিয়ে স্যারের বাড়িতে গিয়ে হাজির।
আমরা তো সবাই অবাক! জয়ন্ত দাদা তো মুখের উপর বলেই দিলো--বউ মনে হয় তোমার একাই আছে।আমরাও তো বিয়া করছি। আমরা তো বউ নিয়া আসিনি।
হাসান ভাই রাগ না হয়ে মৃদু হেসে বলতে লাগলো--জয়ন্ত দা, আমি বউ ছাড়া কোথাও দাওয়াত খাইনা। অসুবিধা নাই, আমার ভাগের কেকটা আমার বউ ই খাবে।
#বাৎসরিক ক্লিয়ান্সের কাজের সময় অফিস থেকে সব স্টাফদের সাপ্তাহিক ছুটি বন্ধ থাকে। এক মাত্র নিকট কোনো আত্মীয় মারা গেলে বিবেচনা করে অফিস কর্তৃপক্ষ অবস্থা অনুমান করে ছুটি দিয়ে থাকেন।
ক্লিয়ারেন্স এনাউন্সের সময় যেহেতু অফিস থেকে বোর্ডে ঘোষনা আসলো,তখন সবাই বাড়ি ঘর, সংসার সব ভুলে গিয়ে জীবিকার দিকে সব ধ্যান,জ্ঞান,পরিশ্রম অফিস মুখি করলো।
কিন্তু এদিকে হুট করে হাসান ভাইয়ের বউ তার বাপের বাড়ি যাবেন ছোট ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে।
হাসান ভাইয়েরও মাথা খারাপ হবার মতো অবস্থা। বউ বাপের বাড়ি যতবার গিয়েছে,ততোবার তিনিও অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন। কিন্তু এখন তো ছুটি কিছুতেই নেওয়া যাবে না। আবার বউকে ছাড়াও একমূহর্ত্য থাকা যাবে না। উভয় সংকটে পড়ে হাসান ভাই গভীর ডিপ্রোসনে চলে গেলেন।
কারো সাথে পরামর্শ না করে হাসান ভাই ম্যানেজারের কাছে তার পারিবারিক জটিলতার কথা বয়ান করে ছুটি কামনা করেন। কিন্তু ম্যানেজার ছুটি মন্জুর করেন নি বলে হাসান ভাই রিজাইন লেটার দিতে আসলে ম্যানেজার ক্ষেপে যান।
আমরা হলরুম থেকে ম্যানেজারের চিল্লানি শুনতে পাচ্ছি--আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন?কাজ না থাকলে তো বউ থাকবো না। আপনি কাজ ফেলে বউয়ের পিছনে দৌঁড়াচ্ছেন। বউ বাপের বাড়ি তো একেবারেই চলে যাচ্ছে না। তিন দিন পরেই ত চলে আসবে।
আমরা বউ ছাড়া দেশের বাহিরে মাঝে মাঝে থাকি কেমনি?
এইসব অতিরিক্ত বউপ্রীতি ছাইড়া কাজে মন দেন।
হাসান ভাই, তার সিদ্ধান্তে অটল। তিনি ছুটি না পেলে চাকরী ছাড়বেন,তবুও বউ ছাড়া এক রাতও তিনি মিস করতে চান না।
অনেক বাক বিতান্ডার পর অবশেষে ম্যানেজার তাকে তিন দিনের ছুটি দিলেন। সাথে এটাও বলে দিলেন,আগামী এক বছর তিনি বউ প্রসঙ্গে যেনো কোনো ছুটির আবদার নিয়ে না আসেন। এই মর্মে হাসান ভাইয়ের ছুটি মন্জুর হলো।
#এক শুক্রবার সদরের বড় কাচা বাজারে হাসান ভাইয়ের সাথে আমার দেখা। বাড়িতে মেহমান আসবে বলে আমি সদরের বড় বাজারে গিয়েছিলাম। সে যা ই হোক। আমি আর হাসান ভাই কাঁচা বাজারে ঢুকলাম। একটি এক কেজি ওজনের শৈল মাছ হাসান ভাইয়ের খুব পছন্দ হলো। মাছটি বিক্রেতা ২০০ এর নীচে দিবেনই না। হাসান ভাই ১৮০এর উপরে এক টাকাও দিতে নারাজ। এই নিয়ে ক্রেতা বিক্রেতার দর কষাকষি চলছিলো। হুট করে হাসান ভাই বিক্রেতাকে বলতে লাগলো--ভাই,তাহলে এক কাজ করুন,আমার বউ শৈল মাছের লেজ পছন্দ করেনা। আপনি লেজের অংশটা কেটে রেখে বাকী অংশটা আমাকে ১৮০টাকার বিনিময়েই দিয়ে দিন
বিক্রেতা তখন হুঙ্কার দিয়ে বললেন, আপনার বউ মাছের লেজ খায়না,তাতে কি?আপনি নিজে তাহলে লেজ খাবেন।
হাসান ভাই দরদ কন্ঠে বলতে লাগলো,ভাই,আমার বউ যা পছন্দ করেনা,সেটা আমিও করিনা। দয়া করে লেজটা কেটে বাকী অংশটা আমাকে ১৮০টাকার বিনিময়ে দিয়ে দিন।
আশে পাশে আরো কয়েক জন বিষয়টা উপলব্দি করে মিট মিট হাসতেছিলো। আমারো মনে মনে চরম হাসি পেলেও আমি চুপ রইলাম। কারন,আমি তো ভালো করেই জানি,তিনি সেইরকম বউ পাগলা।
বিক্রেতার মনেও হয়ত দয়া হলো,তাই তিনি ঠিকই লেজের অংশটা কিছু বাড়তি রেখে কেটে অবশিষ্ট অংশ হাসান ভাইকে দিয়ে বলতে লাগলো--মিয়া,জীবনে বহুত কাস্টমার দেখলাম। আপনার মতো এমন বউ পাগলা কাস্টমার পাইলে আমার তো লাভের টাকা পকেটে না নিয়া এইরকম মাছের লেঞ্জা নিয়া ঘরে ফিরতে হইবো।
পরশিষ্ট ঘটনা---হাসান ভাইয়ের বউ নিয়া এমন আরো অনেক ঘটনাই আমার জানা আছে। তবে সব কথা সবাইকে বলতে নেই। হাসান ভাইয়ের বউ পাগলামী নিয়ে বাকী ঘটনা গুলো আর না ই বা বললাম।
মো ইব্রাহীম খলিল
Comments (0)