গত সপ্তাহে আমার ছেলের সুন্নতে খাৎনা হয়েছে। ছেলের মাথায় পানি দেওয়ার দিন গ্রামের মানুষের সাথে আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। আম্মার সাথে আলোচনা করে দাওয়াতের পর্ব শেষ করেছি তিন দিন আগেই। বিকেল থেকেই বাড়িতে মেহমানদের সমাগম শুরু হয়ে গেছে। আগামীকাল দাওয়াতের দিন ঠিক করা হয়েছে।
আজকে ভোর থেকেই রান্না-বান্নাসহ সকল দিকেই নজরদারি করতে হচ্ছে আমার। গ্রামের একটা মানুষকেও বাকি রাখিনি লিস্টে। যার জন্য খাবারের জায়গাটা বড় করে বাড়ির সামনের জায়গা টুকুতে পর্দা দিয়ে ঘেড়ানো হয়েছে। প্রথম বৈঠকে গ্রামের মানুষ, পারা প্রতিবেশীদের খাওয়ানো হয়েছে৷ পরের বৈঠকে সকল আত্মীয় স্বজনদের।
লক্ষ্য করলাম সবাই দাওয়াত গ্রহন করলেও আমার বড় মায়ের দুই ছেলের পরিবারের কেউ'ই আসেনি। কিন্তু বড় আপারা-সহ দুলাভাইরা আগের দিন বিকালে এসেছে।
নয় বছর পূর্বে আব্বা মারা যাওয়ার তিনদিন পর আমার সৎ ভাইয়েরা ওই বাড়ি থেকে বের করে দেয় আমাদের মা ছেলেকে৷
বড় মা মারা যাওয়ার পর আব্বা আমার আম্মাকে বিয়ে করে আনেন। আম্মাকে প্রথম থেকেই ভাইয়েরা সহ্য করতে পারতো না। আম্মা যথেষ্ঠ করতো তাদের জন্য৷ কিন্তু দিনশেষে সে শুধু অপমান অপদস্তই হয়েছে। আমার আম্মার পেটের আমরা দুই ভাই বোন। আর বড় মায়ের পেটের দুই ছেলে দুই মেয়ে। কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করতো তোমরা কয় ভাইবোন? আমি উত্তর দিতাম তিন ভাই তিন বোন। কিন্তু আমার সৎ ভাইয়েরা সেটা করতো না। ওরা ওদের থেকে আমাদের বরাবরই বাদ রাখতো। ভাবীরাও আমাদের এক চোখেও সহ্য করতে পারতেন না। আম্মাকে জ্বালানোর সাথে সাথে আমার ছোটো বোনকেও অনেক কটু কথা শোনাতো। বোনের যদি ভালো কোনো বিয়ের সমন্ধ আসতো ওরা বদনাম করে ভেঙ্গে দিতো। এক এক করে যখন সব বিয়ে ভেঙ্গে যেতে লাগলো আব্বা তখন ওদের ওপর প্রচন্ড রেগে গেলেন।
সেদিন ছিলো রবিবার। আমাদের গ্রামের হাটবার৷ আব্বা হাটে থেকে আসার পথে একটা ঘটকের মুখে শুনতে পায় বড় ভাই আর ছোটো ভাই মিলে এবারের বিয়েটাও ভেঙ্গে দিয়েছে। সারা পথ আব্বা রাগে গজগজ করতে করতে বাড়ি ফেরেন। হাটের ব্যাগটা উঠোনে রেখেই গলা ফেটে চিৎকার করে ভাই-ভাবীদের ডাকতে থাকেন। ওরা যে যার মতো মিথ্যা বলতে থাকে। এক পর্যায়ে ওরা আব্বার সাথে তর্কাতর্কি বেয়াদবিও শুরু করে দেয়। আব্বা রাগের মাথায় ভাইদের গায়ে হাত তুলতে যেতেই মা দৌঁড়ে গিয়ে আব্বার লাঠির সামনে দাঁড়ায়। সেই লাঠির আঘাতটাও আম্মার কপালেই লাগে। আম্মা মাটিতে পড়া মাত্রই অজ্ঞান হয়ে যায়। বাড়ি শুদ্ধ রক্তপাত আর চিৎকার চেঁচামেচি। আমার ছোটো বোন পাগলের মতো কাঁদতে থাকে।
সেদিনও দেখেছিলাম ভাই-ভাবীরা পাষন্ডের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো সেই নির্মম দৃশ্য। কেউ একবারের জন্যেও ছুঁটে আসেনি। আমার আম্মা কখনোই ওদের সৎ ছেলে-মেয়ে মনে করতো না। বড় আপারা প্রথম থেকেই ভালো ছিলো। নিজের ভাইদের সাথে সম্পর্ক ভালো না ওদের। কি করেই বা থাকবে। ওরা আমাকে ঠকানোর সাথে সাথে ওদের আপন বোনদেরকেও যে ঠকিয়েছে। আব্বা আপাদের জন্য যে সম্পত্তি রেখেছিলেন সেসব নিজেদের দুই ভাইয়ের নামে ভাগ করে নেয়। বড় মা'র ভাগের টুকু ওদের মাঝেই আর আমার আম্মার ভাগের টুকুও ওরাই নেয়।
আমাদের তিন ভাইয়ের সম্পত্তির ভাগ থেকে আমার জন্য রাখে আব্বার বিশাল বড় বাড়িটা থেকে দুই কিলোমিটার দূরে ফসল জমি দেখাশোনার জন্য ছোট্ট একটা বাড়ি ছিলো, সেই বাড়িসহ পশ্চিমে থাকা পুকুরটা। ফসলের জমি থেকে একটা খেত পায় আমি৷ বাকি চারটা ফসলের খেত ওরা দুই ভাই ওদের ভাগেই রাখে।
আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরাসহ গ্রামের মুরুব্বিরাও বলেছিলো মামলা করতে। কিন্তু আমি করিনি৷ আম্মা বারণ করেছিলো। কারণ আব্বা মারা যাওয়ার আগে আম্মাকে বলেছিলেন,
আমায় কিছু দিয়ে যেতে না পারলেও দোয়াটা অন্তর থেকেই করে গেছেন।
আলহামদুলিল্লাহ আমার আব্বার দোয়াতেই হয়তো আজ এতদূর পৌঁছাতে পেরেছি। আমার ভাগে পড়া সেই ছোট্র বাড়িটা আজ অনেক বড় হয়েছে৷ বাড়ির পশ্চিমে থাকা পুকুরটাতে মাছের চাষ শুরু করেছিলাম। পিছনের আঙিনায় মুরগির খামার করেছি। আর চাষাবাদের জন্য ভাগে যে একটা খেত পেয়েছিলাম, সেখানে বারোমাস'ই ফসল উৎপাদন হয়।
আমার কোনোদিনো দুঃখ হয়নি এসব নিয়ে। ভাবতাম ওরা যা কিছু নিয়েছে সেগুলো নিয়ে যদি ওরা সুখে থাকতে পারে থাকুক। এ সংসারে আমার মা না আসলে সবকিছুতো ওদেরই থাকতো। হয়তো কথাগুলো মন থেকেই বলতাম। তবে কে জানতো মানুষের চাপা দীর্ঘশ্বাসেও যে অভিশাপ থাকে।
লোকমুখে শুনেছি আমার সৎ ভাইয়েরা ভালো নেই। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করে ওরা নিজেরাও ভিন্ন হয়ে গেছে। আমার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ভ্যানে করে ওদের বাড়ি যেতে হয়। কেউ কেউ বলতো যখনিই ওরা আমার বাড়ি অতিক্রম করে যেতো তখনিই বাড়িটা আফসোসের চোখে তাকিয়ে দেখতো। আজ আমার সব হয়েছে। ভালো বাড়ি, গাড়ি সবকিছুই। অল্প অল্প করে ব্যবসা থেকে লাভের অংশগুলো জমিয়ে একটা সি এনজি কিনে রাস্তায় ভাড়া দিয়েছিলাম। এখন একটা থেকে পাঁচটা সি এনজি রাস্তায় চলে। সবকিছুই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।
.
হায়াত, বাবা খাবি না তুই?
-আম্মা?
হ্যা বাবা বল।
-বড় ভাইদের বাড়ি যাবে?
তুই, তুই যাবি বাবা?
-হুম।
সত্যি বলছিস তুই যাবি? আমি কত কাঁদতাম লুকিয়ে, তোকে বলার সাহস হয়ে উঠতো না আমার। আর আজ তুই নিজে মুখে বলছিস?
মাগরিবের নামাজ শেষে ব্যাগ ভরতি করে খাবারগুলো গুছিয়ে নিলাম। আম্মা, আমার ছেলে, আর আমি মিলে বড় ভাইদের বাড়ি গেলাম। হাজারটা স্মৃতি জড়ানো সেই বাড়িটা। বাড়ির ভেতর পা রাখতেই চোখদুটো ভিজে উঠলো। উঠোনের মাঝখান দিয়ে দেয়াল তোলা হয়েছে। আব্বার তৈরি করা সেই বাড়িটা আর নেই।
এতদিন মানুষের মুখে শুনেছিলাম ওরা পাপের শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু আজ নিজের চোখে দেখলাম। আল্লাহ কাউকেই ছাড় দেন না। বড় ভাইয়ের ছেলে ভিন্ন হয়ে গেছে। অসুস্থ বাবার খোঁজ খবরও ঠিকমতো নেয় না। আর ছোটো ভাইয়ের আগে থেকেই জুয়ার নেশা ছিলো। এক পর্যায়ে ওর ভাগের সব সম্পত্তি বিক্রি করে আজ অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছে।
আমায় দেখামাত্রই বড় ভাই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলো। ছোটো ভাই মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
-আমাদের ক্ষমা করে দিস ভাই৷ আমরা আমাদের পাপের শাস্তি পেয়েছি। তোকে ঠকিয়ে আমরা সুখী হতে পারিনি রে ভাই৷ তোর হক যে তোকে বুঝিয়ে দেয়নি। দেখ আল্লাহ আমাদেরও তোর হক ভোগ করতে দেয়নি।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মা অঝোরে কাঁদছে। আমার ছেলেটা অবাক চোখে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যগুলো দেখছে৷ আমার ভেতরটাও জড়সড় হতে শুরু করেছে৷ হাজার হলেও একই রক্তেরতো। এই মুহুর্তে কঠিন হৃদয়ের মানুষও যে ওদের ক্ষমা না করে থাকতে পারবে না। আমি কান্না লুকিয়ে বড় ভাইয়ের অসুস্থ হাতটা আমার দুই হাতের মধ্যে নিলাম। মাথা নাড়িয়ে চোখের ভাষায় বোঝালাম,
আমি সব ভুলে গেছি ভাই, ক্ষমা করে দিয়েছি তোমাদের।
কি হবে দু'দিনের দুনিয়ায় এতো অহংকার নিয়ে বেঁচে থেকে? তারচেয়ে ভালো যতদিন বাঁচি সকলের সাথে মিলেমিশে, সকলকে ভালোবেসে।
Comments (0)