Search

ডিভোর্সি

  • Share this:

চোখের কাজলের মত কৃষ্ণবর্ণের গায়ের রং মেয়েটার।অষ্টমবারের পাত্রপক্ষ দেখতে এসে যখন তাকে পছন্দ করে ফেললো তখন আশে-পাশের মানুষগুলো হতবাক।তাও যেনো-তেনো পাত্র নয়।শিক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত পাত্র।দেখতেও সুদর্শন এবং যতেষ্ট ভদ্র।এরকম একটা খুশির ঘটনায় মেয়েটির মা চোখের জল আটকে রাখতে পারলেন না।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।কিন্তু মেয়ে ভাবলেশহীন নির্বিকার ভাবে দাড়িয়ে মায়ের কান্ড দেখতে লাগলো।রাতের বেলা লোকটা ফোন করলো।অর্থাৎ তার হবু স্বামী।

-হ্যালো মেহের নিগার।কেমন আছেন আপনি?

-বিকেল বেলাতেই তো আমার বাসা থেকে বিদেয় নিয়েছিলেন।এর মধ্যে অবস্থার বিশেষ একটা পরিবর্তন হবার তো সুযোগ নেই তাই না?

-আপনি কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছেন?

-বুদ্ধিমানের জন্যে ইশারাই যতেষ্ট।আমি ফোন রাখছি।

-দয়া করে ফোনটা রাখবেন না।

-আমি এখনো আপনার অধিকৃত স্ত্রী নই।এখনি অধিকার খাটাচ্ছেন?আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই।তাছাড়া আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে এক-প্রকার দয়া দেখাচ্ছেন।ঘোর কৃষ্ণবর্ণের একটি মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে আপনি নিজেকে মহানুভব বানাবার ঘৃণ্য একটা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।যাতে করে আমি আপনার সম্মুখে সারাজীবন মাথা নুইয়ে থাকি।

রাশেদ রাগ করে ফোনটা কেটে দিলো।সদ্য পরিচয় ঘটা একজন মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তা কি নিগার জানে না?নাকি তার সাথে নিগারের তিক্ত ব্যবহারটা ইচ্ছাকৃত।রাগ কিছুটা কমলে সে নিগারের ফোন নম্বরে একটা ক্ষুদে বার্তা পাঠালো।

"আগামীকাল আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই।আমি আপনার জন্যে অপেক্ষায় থাকবো।ঠিকানা, বিপ্লব উদ্যান,২নং গেট।"

ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নৈটিফিকেশনের আলোয় বার্তাটা দেখতে পেয়েছে নিগার।তারপর একটা মাত্র চিন্তা তার মাথায় এসেছে।অবশ্যই লোকটার সাথে দেখা করতে আমি যাচ্ছি না।

সত্যিই পরদিন নিগার যায় নি।বারবার কল দেয়াটা অভদ্রতার মধ্যে পড়ে বিধায় রাশেদ হবু স্ত্রী নিগারের মোবাইল ফোনে দুবারের বেশি ফোন দেয়নি।শেষ বিকেলের দিকে কয়েকটা তাজা কৃষ্ণচূড়া সংগ্রহ করে নিয়ে নিগারের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সে।নিগার তখন ছাদে দাড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলো।পেছন থেকে রাশেদ বললো,

-কেমন আছেন নিগার?

-অনিচ্ছা স্বত্বেও নিগার ঘুরে দাড়ালো।তবে প্রশ্নের জবাব দিলো না।

-আমি ভেবেছিলাম আপনি আসবেন,ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে রাশেদ বললো।

-ফুলের জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।তবে আমি আপনাকে কথা দেই নি যে আমি আজ যাবো।

-আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি।

-আপনাকে স্বইচ্ছেয় বিয়ে করছি কিনা সেটা?

-হ্যাঁ।

-এখন তো বিয়ে প্রায় সম্পন্ন হবার ধারে।এখন এই প্রশ্নের কোনো যোক্তিকতা দেখছি না।

-কিন্তু এই প্রশ্নের উপরেই আমাদের ভবিষ্যৎ বিবাহিত জীবন অনেক খানি নির্ভর করছে নিগার।

-আমি যদি বলি আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না,তবে আপনার মন্তব্য কি হবে?

-আপনার কি কোনো সম্পর্ক আছে?কিংবা কোনো উপযুক্ত কারণ?

-আপনি বোধয় সম্পর্কের প্রশ্নটা করে আমাকে বেশ খানিকটা উপহাস করলেন।তবে কারণটা আপনাকে বলতে চাই।আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আপনি আমার বাবার কাছ থেকে বেশ ভালো অঙ্কের টাকার বিনিময়ে আমাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছেন।ঠিক যেমন দৈনন্দিনকার ভোগপণ্যগুলো আমরা অর্থের বিনিময়ে কিনে থাকি।

-আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি একটু বেশিই ভেবে ফেলেছেন?আমি অবাক হচ্ছি এটাই ভেবে যে আপনি নিজের ব্যাপারে এত সংকীর্ণ ধারণা পোষণ করেন।তবে আমার একটা প্রশ্ন ছিলো।আপনি তো উচ্চ শিক্ষিত। চাইলে কোনো চাকরি করতে পারতেন।এতদিন পর্যন্ত কিছুই করলেন না যে?

-কারণটা খুবই সহজ।আমার বাবা কখনোই চান নি সেটা।তার অর্থের কোনো কমতি নেই।একটা নির্দিষ্ট সময় পর তিনি আমাকে স্রেফ একটা মাংসের বোঝা ছাড়া ভিন্ন কিছু মনে করেন না।ব্যাপারটা অনেকটা শখ করে কেনা একুরিয়ামে লালিত মাছের মত।শখ ফুরাবার পর বিনে খরচে রাখাও যায়না আবার ফেলেও দেয়া যায় না।

কথাগুলো বলে তাচ্ছিল্যের ভাবে একটু হাসলো যেনো মেয়েটা।চরম ক্ষোভ জমে আছে এই বাস্তবতার প্রতি।যদিও এটাকে বাস্তবতা বলা যায় না।সমাজের বৈষম্য তো আমাদেরই সৃষ্টি করা।

- আমি কোনো অর্থের বিনিময়ে আপনাকে বিয়ে করছি না নিগার।আমি সজ্ঞানে পবিত্র চিন্তায় আপনাকে বিয়ে করছি।এর পেছনে আমার একটা মোটিভেশনাল গল্প আছে।আপনি চাইলে আমি আপনার সাথে শেয়ার করতে পারি।তাছাড়া আপনি আমাকে যতটা খারাপ মানুষ হিসেবে ভাবছেন আমি ততটা খারাপ মানুষ নই।যদিও এ জীবনে পাপ যতেষ্টই আছে আমার।তবে গল্পটা শুরু করবার আগে আপনার কাছে এককাপ কফির আবদার করছি।আমার খুব কফির তেষ্টা পেয়েছে।

- ঠিক আছে রাশেদ সাহেব।আপনি একটু অপেক্ষা করুন।আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে রাশেদ খেয়াল করলো নিগার কিছুটা কোমল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে।বোধয় সে নিগারের আস্তা কিছুটা হলেও অর্জন করতে পেরেছে।রাশেদ বলতে শুরু করলো,

-খুব সম্ভবত আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি।তার আগের স্মৃতিগুলো অবশ্য মনে নেই।সেসব হয়তো আরো জঘন্য ছিলো।পথে প্রান্তরে নানা বয়েসের লোক আমাকে ডিভোর্সির ছেলে বলে খোঁচাতো।আমি কোনো জবাব দিতে পারতাম না।অবশ্য আমি তখন ঐ শব্দটার অর্থও পরিষ্কারভাবে জানতাম না।কিন্তু তারা এমন বিচ্ছিরি ইঙ্গিতে কথাটা আমাকে বলতো মনে হতো খুব খারাপ কিছুই বলছে।দীর্ঘ সময় এই ব্যাপারটা আমি নিজের মধ্যেই গোপন রেখেছিলাম।কখনো মাকে জানাবার সাহস হয়নি।তাছাড়া মায়ের সাথে খুব একটা কথাও বলতাম না।সহ্যের সীমা তখনই পার হয়েছিলো যখন আমি দশম শ্রেণীর পরিক্ষার্থী।এবং স্বাভাবিকভাবে তখন আমি শব্দটার পরিষ্কার অর্থটাও জানতাম।ধীরে ধীরে জানতে পারলাম বাবা অর্থের বিনিময়ে অর্থাৎ বেশ মোটা অঙ্কের যৌতুকের বিনিময়ে আমার মাকে বিয়ে করেছিলেন।শুধুমাত্র মায়ের রং কৃষ্ণবর্ণের ছিলো বলে।কিন্তু আমার বাবার অত্যাচারে মা ঐ সংসারে টিকতে পারেন নি।বাবা সবসময় চাইতেন মাকে সংসার থেকে বিদেয় করে নতুনভাবে সংসার শুরু করতে।অন্য এক বিধবা মহিলার সাথে তার অনৈতিক সম্পর্কের কথাও মা জানতে পারেন।তারপর একটা শর্ত দিয়ে একদিন মা বললেন, তুমি শর্তটা মানলে তবেই আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাবো চিরদিনের মত।

- কি শর্ত দিয়েছিলেন আপনার বাবা?

- আমার উপর পিতৃত্বের সকল দাবী ছেড়ে দিয়ে আমাকে চিরদিনের জন্যে মায়ের সাথে দিয়ে দিতে হবে।

- আপনার বাবা মেনে নিয়েছিলেন?

- প্রচন্ড লোভী আর যতেষ্ট খারাপ মানুষ হিসেবে সামান্য শর্তটা মেনে নেয়াটা স্বাভাবিক না?

- সামান্য শর্ত?

- অন্তত উনার কাছে সামান্য।তারপর মা চিরদিনের জন্যে বাড়ী থেকে চলে গেলেন।ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেয়া হলো এবং নির্বিঘ্নে মা তাতে সই করে দিলেন।এই গল্পটা আমি যেদিন জানতে পেরেছি সেদিন থেকেই হৃদয়ে গভীর ক্ষত হয়ে গেছে।আমি সেই ক্ষত মুছার চেষ্টায় আছি নিগার এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।শুধুমাত্র এটাই যে একমাত্র কারণ তা নয়।আপনার প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধ এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছে।আমি চাইলেও একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আপনাকে মুছতে পারবো না হৃদয় থেকে।আপনার মধ্যে কেনো জানি আমার সেই ডিভোর্সি অভিমানী মায়ের ছায়া খুঁজে পাই।আজ আসি নিগার।আপনার যদি মনে হয় আমাকে বিয়ে করতে আপনার ঘোর আপত্তি আছে তবে আমাকে জানিয়ে দেবেন।ফোন করতে হবে না।শুধুমাত্র একটা ক্ষুদেবার্তা পাঠালেই চলবে।

রাশেদ চলে গেছে।কবেই যে তার সাথে চার ঘন্টা কেটে গেছে হিসেব নেই।আকাশ ভর্তি ফকফকা চাঁদের আলো।নিগার খেয়াল করলো, তার চোখের কোণে নোনতা জল জমেছে।সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।রাশেদ নামের ঐ ছেলেটিকে পাগলের মতো ভালোবাসবে।ততক্ষণে রাশেদের ফোনে নিগারের টাইপ করা ক্ষুদেবার্তা পৌঁছে গিয়েছে।রাশেদের ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো,

"আপনার চেয়ে যোগ্য দ্বিতীয় কোনো মানুষ হয়তো পাবো না যিনি আমার নিজের প্রতি নিজের সংকীর্ণতাকে মুছে দিতে পারবে।আমি আপনার সহচর্য পাবার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো।"

 

আবদুল্লাহ ইবনে আলী

Tags:

About author
StorialTech is an admin of this multi-platform website. StorialTech shares stories, tutorials, web templates, pdf books, and movies for you to easily access anything related to this website.