আমার বাপের বাড়ি যশোর শহরের উপর।
বিয়ে হয়েছে গ্রামে।গ্রামে সব রকমের পাখি আছে কিন্তু কাক নেই। ভোরবেলা শতশত পাখির মিষ্টি মধুর ডাকে ঘুম ভাঙে।কিন্তু আমার মন কা কা ডাক শোনার জন্য হাহাকার করে।
একদিন সকালে ওয়াশরুমে যেয়ে দাঁত ব্রাশ করছি, হঠাৎ কানে এলো মিষ্টি মধুর আওয়াজ কা কা কা।আমি খুশিতে ওয়াশরুম থেকে এক দৌড়ে বেডরুমে এসে স্বামী ঘুমাচ্ছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে বললাম,বাপের বাড়ি থেকে কাক ভাইজান এসেছে। আমি ছাদে গেলাম এখনই হয়ত ভাইজান চলে যাবে এই বলে আমি দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে।
আমার স্বামী হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আমার কথা বুঝতে না পেরে, আমার পেছনে পেছনে ছাদে উঠছে আর বলছে, কোন ভাইজান এসেছে? এত তাড়াতাড়ি কেন চলে যাবে? তুমি ছাদে উঠলে কেন?
আমি ছাদে উঠে কাকের সাথে হাসিমুখে কথা বলছি, ভাইজান ভাল আছেন? বাড়ির সবাই ভাল।
আমার স্বামী ছাদে উঠে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে আমি কাকের সাথে কথা বলছি।
নিতা কোন ভাইজান এসেছে?তুমি তাড়াহুড়ো করে ছাদে আসলে কেন?
চুপ করো কাক ভাইজান এসেছে। জোরে কথা বললে উড়ে যাবে।
ও হতাশ গলায় বলল, এ কোন পাগলীকে বিয়ে করে আনলাম!
পাগলী বলবে না, তুমি আমার কষ্ট কিভাবে বুঝবে? তোমাকে তো আর বিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ি পরিচিত জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়নি? এ কষ্ট বোঝার ক্ষমতা তোমার কোনোদিনও হবে না। বাপের দেশের ফকির আসলেও মনে হয় কত আপনজন!
গ্রামে বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে ফেরিওয়ালা আসে। হাঁড়িপাতিল নিয়ে একটা ছেলে আসে বাইশ কি তেইশ বছর বয়স হবে, কালো রোগা।মাঝে মাঝে ওর কাছ থেকে থালা বাটি কিনি।
একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বাড়ি কোন জায়গায়?
আপা আমার বাড়ি যশোর শহরে কাজি পাড়া।
শুনে ধাক্কা খেলাম আমার বাপের বাড়ি আর কাজি পাড়া কাছাকাছি।
আমি তো খুশিতে বলে উঠলাম,ভাই রে তুমি তো আমার বাপের বাড়ির এলাকার লোক। ছেলেটাও খুশি হয়ে আপা ডাকে। ওর কাছ থেকে হাড়ি, কড়াই, থালা, বাটি কিছু না কিছু কেনবই। জানি আমার কাছ থেকে দাম বেশি নিচ্ছে তারপরও কিনি।
একদিন সকালে নাস্তা বানিয়েছি পরোটা আলুভাজা, ডিমভাজা সাথে মিষ্টি। ঐ ছেলে হাঁড়িপাতিল বিক্রি করতে এসেছে। আমি ওকে বাড়ির ভিতর ডেকে, ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে নাস্তা করালাম।হাজার হোক বাপের দেশের লোক!
আমরা তিন বোন, ছোটো বোনের বিয়ে হয়নি, পাত্র দেখছি। বোনটা বেশ সুন্দরী ফর্সা লম্বা। আমি ঐ ছেলেটাকে বললাম, ভাই তুমি তো কত জায়গায় ফেরি করো।কত মানুষের সাথে জানাশোনা, আমার ছোটবোনকে বিয়ে দেবো। ভালো পাত্রের সন্ধান পেলে জানাবা।
ঠিক আছে আপা,আপনার বাপের বাড়ির ঠিকানা দিন একদিন আপনাদের পাড়ায় যেয়ে ফেরি করে আসব আর আপনার বোনকে দেখে আসব।
তিনদিন পর ছেলেটা এসে আমাকে ডাকছে, আমি ওকে ঘরে এনে বসালাম।
আপা গতকাল আপনাদের বাড়ি গিয়েছিলাম, আপনার বোন তো খুব সুন্দর আমার পছন্দ হয়েছে। আপা আমি আপনার বোনকে বিয়ে করব।
ওর কথা শুনে আমি হা করে আছি। আমার কথাবলার শক্তি হারিয়ে গেছে।
আপা আমার রোজগারপাতি ভালোই প্রতিদিন দেড়শো-দুইশো টাকা আয় হয়।
তবে বিয়েতে আমার একটা শর্ত আছে। আপনাদের যশোরের জমি, বাড়ি সব আমার নামে লিখে দিতে হবে। বিয়ের আসরে আগে জমি, বাড়ির দলিল হাতে পাবো তারপর কবুল বলব।আমি এখন যাই, আগামীকাল এসে আপনার মতামত জানবো।
আমি হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছি, মানুষ অধিক শোকে পাথর হয় তারচেয়ে বেশি শোক পেলে কি হয় আমার জানা নেই। আমি পাথর স্টোন সব হয়ে হা করে দাড়িয়ে আছি। মুখের ভেতর ডজন খানিক মশা-মাছি ঢুকলো আর বেরিয়ে আসলো আমার কোন হুশ নেই।
যখন হুশ আসলো আমি চিৎকার করে উঠলাম,হারামজাদা বলে কি!ওর ঠ্যাং যদি আমি না ভাঙি তাহলে আমার নাম নিতা না, রাগে আমার শরীর কাঁপছে।
আমার চিৎকার শুনে ভাসুরের ছেলেরা ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে ছোটো মা? তুমি এমন করছো কেন?
থালাবাটি বিক্রি করে যে ছোড়া, ও যেন কোনোভাবেই আমাদের পাড়ায় ঢুকতে না পারে সেই ব্যাবস্হা করবি।হারামজাদার কত্তবড়ো সাহস! আমার বোনকে বিয়ে করতে চায় সাথে সম্পত্তিও চায়। তোরা কিন্তু গায়ে হাত তুলবি না, হাজার হোক বাপের দেশের লোক।
তারপর থেকে ঐ ছোড়ার মুখ আর দেখিনি।
নাকে ক্ষত দিয়েছি, কান মলেছি আর কোনোদিন কাউকে ছেলে খুঁজে দেওয়ার কথা বলব না।
এখন আমার মেয়ে বড়ো হয়েছে বিয়ে দিতে হবে।বোনের বিয়ে নিয়ে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে তারপর কাউকে ছেলে খুঁজে দেও বলতেও ভয় লাগে। কি জানি হয়তো বলে বসবে, আপনাদের গ্রামে যত বিষয়-সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর আছে সব আমার নামে লিখে দেন তাহলে আপনার মেয়েকে বিয়ে করবো! তখন ছেলে, স্বামীর হাত ধরে গাছতলায় থাকতে হবে। তারচেয়ে মেয়ে আইবুড়ো থাক সেও ভালো।
ইসরাত জাহান নিতা
Comments (0)