-রমা, এই রমা, কতবার বলেছি তোকে আমার পড়ার টেবিলে হাত না দিতে।
রাবিনের আওয়াজ শুনে অনেকটা দৌড়ে রমা চলে আসলো। সেই সাথে তার মা ইতু বেগম ও আসলো। রমা বেগম বয়সে ইতু বেগমেরই সমান।
মা এসে জিজ্ঞেস করলেন,
-কি হয়েছে, রাবিন? আর মায়ের সমান একজন মানুষের সাথে এটা কি ধরণের ব্যবহার?
রাবিন, মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে রমা বেগমের দিকে তাকালো। সে রাগে ফুসছে।
রমা বেগম হাতজোর করে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে বললেন,
-আমি তো শুধু আপনার পড়ার টেবিলটা গুছিয়ে দিয়েছি।
-এই তোর গুছানোর নমুনা! আমার assignment এর কাগজ গুলো কোথায়?
-কি কোথায় সাব?
রমা বেগম assignment শব্দটা বুঝলেন না। রাবিনের রাগটা আরো বেড়ে গেল। সেই সাথে এক রাশ বিরক্তি।
-এখানে কিছু আলগা কাগজ ছিলো। সেগুলো কোথায়?
রমা বেগম তক্ষুনি দৌড়ে গিয়ে ময়লার ঝুড়ি থেকে কিছু কাগজগুলো এনে দিয়ে বললেন,
-আমার ভুল হইয়া গেছে সাব। আমি ভাবসি ওই কাগজ গুলো আর লাগবো না। তাই ময়লার ঝুড়িতে ফালাইয়া দিসি।
কাগজ গুলোর বেহাল অবস্থা। রাগে ক্ষোভে রাবিন বলে উঠলো,
-তুই এক্ষুনি বের হ রুম থেকে। নয়ত আমার হাত উঠে যাবে। থাপ্পড় মেরে বসবো।
রমা বেগম চোখভর্তি পানি নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলেন। হয়ত থাপ্পড়টা তাকে মারা হয় নি। কিন্তু সে অনুভব করলো তাকে অদৃশ্য এক থাপ্পড় মারা হয়েছে।
ইতু বেগম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। কিছুটা ঘোর কাটতেই তিনি বললেন,
-তোমার একি ব্যবহারের নমুনা! যদি তুমি মানুষের সাথে ব্যবহারটাই ভালো করতে না পারো তাহলে আর কি হবে পড়ালেখা করে?
-মা, প্লিজ, তুমি এখন যাও তো। দেখো, কি অবস্থা করেছে কাগজ গুলোর।
- শুধু একটু ভাজ পড়েছে। আর শুকনো ময়লার ঝুড়িতেই সে ফেলেছিলো। তাই তেমন কোনো সমস্যাও হয় নি। জমা দেয়া যাবে এগুলো।
রাবিন রাগে কাগজ গুলো ফ্লোরে আছড়ে ফেলে দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
পরের দিন সকালে ঘর টা গুছানো পেলো না রাবিন। অন্যসময় ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েই দেখে তার ঘরটা গুছানো হয়ে গেছে। সে আবার চেঁচিয়ে রমা রমা বলে ডাকলো। রমার বদলে তার মা এসে হাজির হলেন।
-কি হয়েছে?
-আমার ঘরটা এখনো গুছানো হয় নি কেন? রমা কোথায়?
-উনাকে অন্তত রমা আন্টি বলে ডাকো। তোমার থেকে বয়সে অনেকটা বড় উনি।
-একটা কাজের মহিলাকে আন্টি বলে আমি ডাকতে পারবো না। তাকে বলো আমার ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে যেতে।
-নিজের কাজ নিজে করে নাও। আমি রমা আপাকে বলে দিয়েছি সে আর তোমার কোনো কাজ যেন না করে। কালকে কাগজ ফেলে দিয়েছিলো, এরপর দেখা যাবে আজকে বইটই সবই ফেলে দিলো।
রাবিন হতভম্ব হয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। ইতু বেগম তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন।
খাবার টেবিলে থমথমানো পরিবেশ। রাবিনের মুখ বরাবরের মত বিরক্তিতে ভর্তি। মাহিন সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,
-তুমি ঠিক করেছো আজ থেকে রমা আর রাবিনের কোনো কাজ করবে না?
ইতু বেগম স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলো,
-হ্যা।
-কেন জানতে পারি?
মায়ের উত্তর দেয়ার আগে রাবিন বলল,
-কেন আবার? আমি এই মহিলাকে তুই তোকারি কেন করি, সম্মান দেই না এজন্য বারণ করেছে।
মাহিন সাহেব ইতু বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি বাড়াবাড়ি করছো?
-না মনে হচ্ছে না। আমার এটাও ইচ্ছা ছিলো তোমার ছেলের পড়াশুনাটাও বন্ধ করে দেই। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
-কেন সম্ভব না? বন্ধ করে দাও। তুমি ওর খাওয়া দাওয়াটাও বন্ধ করে দাও।
মাহিন সাহেব ব্যাঙ্গ করে উত্তর দিলেন।
রাবিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-মা, তুমি ভয় পাচ্ছো যে একজন কাজের লোক চলে গেলে আর কাজের লোক পাবো না? সেজন্য ভালো ব্যবহার করো তার সাথে? আর সে আমাদের কাজ করার জন্য বেতন পায়, এমনি এমনি করে দেয় না কাজগুলো।
ইতু বেগম অবাক চোখে রাবিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
মাহিন সাহেব রাবিনের কথাটাকে উস্কে দিয়েই যেন বলল,
-ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না।
ইতু বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে একটু হাসলেন। মনে মনে বললেন,
'নাহ, ছেলেকে আর মানুষ করতে পারলাম না। আমার এতদিনের পরিশ্রম ব্যর্থ।'
এরপর উঠে গিয়ে রমা বেগমের সামনে দাঁড়ালেন। রমা বেগম তখন রান্নাঘরে ছিলেন।
তাকে দেখে রমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
-কিছু লাগবো, আপা?
হাতের মধ্যে এই মাসের বেতনটা গুজে দিতেই রমা বেগম বলে উঠলেন,
-মাসের তো এখনো শেষ হয় নাই।
ইতু বেগম ধীর গলায় বললেন,
-কালকে থেকে আর আস্তে হবে না, রমা আপা।
(সমাপ্তি)
অরণী মেঘ
Comments (0)