প্রচন্ড ডিপ্রেশড হয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটার পার্লস চ্যাক করে ডাক্তার বললো,
--আপনি প্রচুর টেনশনে আছেন? তা কি নিয়ে এত চিন্তা করছেন?
তখন মেয়েটার পাশে বসে থাকা ভদ্রমহিলা মানে মেয়েটার মা বললো,
--আসলে আজ ওর গায়ে হলুদ হওয়ার কথা ছিলো।কোনো একটা কারণে বিয়েটা ভেঙ্গে যায়।
ডাক্তার ভদ্রমহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
--কারণটা কি?
--আমার মেয়ের গায়ের রং ফর্সা নয়।এটাই প্রধান কারণ ছিলো।
ডাক্তার মৃদু হেসে মেয়েটিকে বললো,
--আল্লাহ ! কি বলে?
এই মেয়ে যেখানে আপনার নামাজ কুরআন পড়ে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ।সেখানে আপনি কিনা ডিপ্রেশড হয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছেন?আপনি তো একজন বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের হাত থেকে বেঁচে গেছেন।
ডাক্তার নানাভাবে মেয়েটাকে বোঝাচ্ছে।
এরই মধ্যে কিছু খাবার এবং পানি নিয়ে এক ভদ্রলোক উপস্থিত হলেন। যিনি মেয়েটির বাবা।
ডাক্তার সেই ভদ্রলোকের পরিচয় জানার পর তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
--আঙ্কেল, আপনি তো ঠকে গেছেন!
ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
--মানে?
--মানে হচ্ছে, আপনি এত্ত সুন্দর এবং স্মার্ট। সেই দিক থেকে আন্টি তো কালো।আপনি ফর্সা হয়ে একটা কালো মেয়েকে বিয়ে করে ঠকে গেলেন না?
ভদ্রলোক ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললো,
--বাবারে,চোখ বন্ধ করলে সবই অন্ধকার, আবার চোখ খুললে সবই আলো।
ডাক্তার তখন বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
--যদি কখনো আপনার বাবার মতো কাউকে পেয়ে যান তখনই বিয়ে করবেন।
শুনুন,জীবন ভয়ংকর রকমের সুন্দর।ডিপ্রেশড হয়ে বেডে না শুয়ে থেকে আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করে জীবনটা উপভোগ করুন।এত সহজে হার মেনে নিবেন না।
কথাটা বলেই ডাক্তার চলে যায়।
গল্পটা ঠিক এভাবেই শুরু হয়।এবং মেয়েটা ছিলাম আমি,তাহিয়া।
সেই ডাক্তারের সাথেই কাকতালীয়ভাবে আমার আবার দেখা হয় এবং ডাক্তার সেদিন পাত্রী দেখার উদ্দেশ্যেই আমাদের বাড়িতে আসে।কিন্তু আমি যে সেই মেয়ে, এটা ডাক্তার কিংবা আমার পরিবারের কেউই জানতো না।ছেলেটার অর্থাৎ ডাক্তারের নাম ছিলো জিহাদ।
যথারীতি মেয়ে দেখতে এসে জিহাদ এবং আমি দুইজনে অবাক হয়ে যাই।পরিবারের সবাই স্বাভাবিক কথাবার্তা বলার পরে আমাদেরকে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে দেয়।তখন আমি জিহাদকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
--আপনি জানতেন না? আমি সেই বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া মেয়েটা।কিংবা মেয়ের গায়ের রঙ কালো এমন কিছুও শুনেন নি?
জিহাদ মৃদু হেসে বললো,
--না, আমি কিছুই জানতাম না।
--আচ্ছা।
এখন তো জানলেন।
--জ্বি জানলাম।কিন্তু আমার আপনাকে কিছু বলার আছে।
--জ্বি বলুন।আমি এখন মানসিকভাবে সকল কিছু শোনার কিংবা সকল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকি।
--আপনাকে ঐদিন হসপিটালে একটা কথা বলেছিলাম।মনে আছে?
--জ্বি।
--আমিও আপনার বাবার মতো এটা বিশ্বাস করি যে চোখ বন্ধ করলে সব অন্ধকার এবং চোখ খুললে সবই আলো।
অবাক হয়ে জিহাদের দিকে তাকিয়ে বললাম,
--ঠাট্টা করছেন আমার সাথে?
--একদম না। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।এখন কেবল আপনার সিদ্ধান্তটা জানার বাকি।
সব কিছু জানা শোনার পর শেষ পর্যন্ত জিহাদের সাথেই আমার বিয়েটা হয়।
বিয়ের প্রায় বছর পাঁচেক পর একদিন হুট করেই আমার সাথে রূপক এর দেখা হয়ে যায়।রূপক হলো সেই ব্যক্তি যার সাথে পারিবারিকভাবে আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর, মেয়ের গায়ের রঙ ফর্সা নয় বলে যে বিয়ের দুইদিন আগে বিয়েটা ভেঙ্গে দেয়।সেই রূপকের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি।
মৃদু হেসে রূপককে উদ্দেশ্য করে বললাম,
--আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করবো না।তবে এতদিনে বিয়ে করে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। বউয়ের গায়ের রঙ ফর্সা তো?
--তাহিয়া..
--আরে হ্যাঁ।আমিও বোকার মতো প্রশ্ন করছি! গায়ের রঙ ফর্সা তো হবেই।যাকগে সে কথা।ঐদিন আপনাকে আমার অনেক কথাই জিজ্ঞেস করার ছিলো।কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করছেনা।সময়ের সাথে সাথে কথাগুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।এখন কথাগুলো মনেও নেই আমার।তবে হ্যাঁ,আমি কিন্তু আপনাকে কখনোই অভিশাপ দেই নি।মাফ করে দিয়েছিলাম।কারণ আমি চাইনি,আমার জীবনে যা হয়েছে এমন ঘটনা আর কারো সাথে হোক।
--তাহিয়া..
রূপককে কথা বলার মোটেও সুযোগ দিচ্ছিনা।বরং একগাল হেসে উৎফুল্ল হয়ে বললাম,
--এই যে আমার বর।উনার সাথে পরিচিত হয়ে নেন।দেখুন আমি কালো হওয়া সত্বেও আমার বর কিন্তু ফর্সা।অবাক করা বিষয় না?এবং মনের দিক থেকে অনেক বেশি উচ্চমানের একজন আদর্শ মানুষ।যার ব্যক্তিত্ব আমাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে।ভালোই হয়েছিলো ঐদিন আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছেন।নতুবা আজ আমি এমন জীবনসঙ্গী পেতাম না।
--আমাকে কিছু বলতে দাও তাহিয়া।
--উহু না, একদম না।আপনি কিছুই বলবেন না।কারণ যেদিন আপনি বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন ঐদিন আমারও অনেক কিছু বলার ছিলো।কই, কেউ তো আমাকে সেইদিন বলার সুযোগ দেয় নি!
আপনারা ছেলে বলে কথা কেবল আপনাদের বলার থাকতে পারে!আমরা মেয়ে বলে আমাদের কিছুই বলার থাকতে পারে না?আচ্ছা বাদ দেন।
দু'আ করি ভালো থাকুন সর্বদা।
কথাটা বলেই জিহাদের হাত ধরে এক পা এগুতেই জিহাদ পেছন ফিরে রূপককে উদ্দেশ্য করে বললো,
--মি.রূপক, নিজের বউ বলে বলছিনা।যুগের তুলনায় এমন মেয়ে স্ত্রী হিসেবে পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার।যেটা আপনি পাওয়ার সন্নিকটে গিয়েও হারিয়ে ফেললেন।আপনার জন্য
শুভ কামনা
।
আমি আর জিহাদ বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটছি।মাথার ভেতরে রূপকের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়া,সেই কথাবার্তা, সেইসব দিনগুলো ঘুরছে।
অবশ্য পরবর্তীতে শুনেছি রূপক বেশ ফর্সা বড়লোকের মেয়েই বিয়ে করেছিলো।যে মেয়ে রূপকের মায়ের প্লেটে কখনো ভাত বাড়েনি।ওর ভাইবোনদের ওর থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
অথচ আমার সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ব্যক্তিগতভাবেই আমার কাছে অনুরোধ করেছিলো,তার মা'কে শাশুড়ী নয় মায়ের চোখে দেখতে হবে।তার ভাইবোনদের ননদ কিংবা দেবর নয় নিজের ভাইবোনের চোখে দেখতে হবে।আমিও মনে মনে সব গ্রহণ করে নিয়েছিলাম।অবশ্য সব মেয়েই চায় নিজের সংসারের সবাইকে আপন করে নিতে।
উনার মনের মতো করেই নিজেকে গড়ে নেবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।অথচ...
শুনেছি রূপক আর তার ফর্সা বউয়ের সংসারটা নাকি একবছর খুব কষ্ট করে টিকেছিলো।মেয়ের অন্য কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো।সে ঐ ছেলের সাথেই ভেগেছে।
অথচ রূপকের জীবনে এমন কিছু হোক সেটা আমি কখনোই চাইনি।কারণ মন ভাঙ্গার কষ্টটা মানুষ খুব সহজে হজম করতে পারে না।কিংবা মেনে নিতে পারে না।একদম পারে না।
#উম্মে_হাবিবা_তানহা
২৮-০৬-২০২১
Comments (0)