এই পর্যন্ত দশের অধিক পাত্র আমাকে দেখে গেসে। অথচ কারোরই আমাকে পছন্দ হয়নি নাকি আমি পছন্দ হতে দেই নি, তা নিয়ে সকাল থেকে মা-বাবা বিস্তার আলোচনা করছে। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটু আধটু শুনছি।
একজন যদি বলে আপনার মেয়েরই দোষ, সে ইচ্ছা করে পাত্রদের ভাগিয়ে দেয় তাহলে আরেকজন বলে আমার মেয়ের দোষ না তোমার দোষ, কি সব ফালতু পাত্রের খোঁজ নিয়ে আসো তুমি।
আমি আবছা ঘুমেও স্বপ্ন দেখছি, তার ভিতরেই মা-বাবার আলোচনার কিছুটা কানে ভেসে আসছে। এক পর্যায়ে মনে হলো আমার স্বপ্ন থেকে আলাদা হয়ে মা-বাবার আলোচনার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছি। কিছুটা বিরক্ত হয়ে স্বপ্নে ফেরার চেষ্টা করতে লাগলাম কিন্তু তা আর হলো কিসে। ধীরে ধীরে আমার মার মাইক গলার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে লাগলাম। তার মানে আমার ঘুম ভেঙে গেসে।
তাও নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাবাকে ডেকে বললাম
~ বাবা আমার ঘুম কি ভেঙে গেলো?
~ হ্যাঁ মা, তুমি তো আমার সাথে কথা বলছো। তার মানে নিশ্চয়ই তোমার ঘুম ভেঙে গেসে। তুমি চাইলে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে পারো। আমি আর তোমার মা এইরুম থেকে চলে যাচ্ছি।
পাশ থেকে মা এসে বললো~ আশকারা দিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে এই বানিয়েছেন আপনি! দুপুর কয়টা বাজে খেয়াল আছে? আজকে তাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে তা ভুলে গেসেন?
~ রাখো তো তোমার ছেলে পক্ষ। তুমি সব ফালতু ছেলেই নিয়ে আসবা। আমি আমার মেয়ের জন্য ভালো ছেলে খুঁজে আনবো। তোমার ছেলে দেখা আর লাগবেনা।
~ জানা আছে কতো ভালো ছেলে নিয়ে আসবেন। আমি তাও ফালতু ছেলে আনি, আপনি নিয়ে আসবেন জোকার। এইবার যেই ছেলে আসবে সে অনেক স্মার্ট,সেন্স অব হিউমার অনেক ভালো।অনেক ম্যাচিউর একটা ছেলে দেখেছি আমি।
মার কথা শুনে বুঝলাম আজকে আবার নাটকের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যেই নাটকের নায়ক-নায়িকা, ডিরেক্টর, এডিটিং, মিউজিক সব জায়গায় শুধু একটা নাম ফাল্গুনী, ফাল্গুনী, ফাল্গুনী। মানে নাটকের সবকিছুই আমাকে একা করতে হবে। ভাবা শুরু করলাম কি নিয়ে নাটক করা যায়। হঠাৎ মাথায় আসলো সেন্স অব হিউমার নিয়ে করা যেতে পারে। মা বললো ছেলে অনেক ম্যাচিউর, কোনো ম্যাচিউর ছেলে নিশ্চয়ই কোনো ছেলেমানুষী মেয়েকে পছন্দ করবে না।
যেই ভাবা সেই কাজ। বাদামী রঙের জিন্সের সাথে হলুদ টি-শার্ট কোনো দিক থেকেই মানাবে না জেনেও হলুদ টি-শার্ট পড়লাম। টকটকে লাল কেডস সাথে টকটকে লাল লিপস্টিক। হাতের দশটা আঙুলে দশ রঙের আংটি পড়লাম। তাও কিছুটা কম কম লাগছে। তাই গাঢ় সবুজ রঙের টিপ পড়লাম। ভূতের মতো করে মোটা মোটা করে কাজল দিলাম। চুলে তেল দিয়ে টানা টানা করে দুই বেণী করলাম। আর কিছু করতে পারলাম না তার কারণ মা ডাকতে ডাকতে গলা ফাটিয়ে ফেললো।
মার সামনে যেতেই বলে~ এটা কি সেজেছিস?
~ যা সেজেছি তাই থাকবে। আমি চেঞ্জ করবো না। যদি তুমি চেঞ্জ করতে বলো তাহলে পাত্র পক্ষ কিন্তু চলে যাবে কারণ আমার এগুলা চেঞ্জ করতে কমপক্ষে দুই ঘন্টা লাগবে।
~ ফাল্গুনী তুই বড্ড বেড়েছিস! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। ছেলেপক্ষ শুধু বের হয়ে দেখুক। তুই বুঝবি তোর এই নাটকের কি দশা আমি করি।
মনে মনে বুঝলাম আজকে আর রক্ষা নাই কিন্তু তবুও খুশি হলাম কারণ এই লুকে কোনো ছেলে কেনো কোনো মেয়েও পছন্দ করবে না তাও আবার ছেলে নাকি ম্যাচিউর, সেন্স অব হিউমার খুব ভালো। মনে মনে নিজেকে নিজেই বাহবা দিচ্ছি বাহ ফাল্গুনী তুমি তো খুব ভালো ডিরেক্টর। উফ যা সেজেছো এবার শুধু নাটক টা প্লে করো ভালোমতো তাহলেই কেল্লাফতে।
ছেলের সামনে গিয়ে দেখলাম ছেলের বাবা আর ছেলে আসছে। আর কেউ নেই। আমি মোটামুটি নাটক ভালোভাবেই শুরু করলাম। প্রথমে ছেলের বাবাকে বললাম আসসালামু আলাইকুম নানা, পরে ছেলেকে বললাম আসসালামু আলাইকুম আংকেল।
আংকেল আর নানা বলাতে মোটামুটি থতমত খেলো দুজনেই। আমার মা আমাকে ধমক দিতে নিয়েও দিতে পারলো না, মানসম্মান বলে একটা কথা আছে না। যখন ছেলের বাবা বললো উনি নানা নয় এবং উনার ছেলে আংকেল নয়, তখন আমি সরি বলে বসলাম। ছেলের বাবা আমাকে তেমন প্রশ্নই করেনি আমার নাটক ভালো মতো জমছিল না। হুট করেই ছেলের বাবা বলে বসলো ছেলেকে আর আমাকে আলাদা কথা বলতে দিতে। এইতো সুযোগ পেলাম এবার ছেলেকে এমন নাটক দেখাবো দৌঁড়ে পালাবে। আমার মা মোটেও চাচ্ছিলো না আলাদা কথা বলতে দিতে তার কারণ আমি যে নাটক করবো মা ভালো মতোই জানে। কিন্তু মাঝখানে বাবা আমাকে হেল্প করলো।
ডান পাশে আমি বসে আছি আর বাম পাশে ছেলেটা। না মা ভুল বলেনি। ছেলেটা দেখতে মাশআল্লাহ। কিন্তু যতোই মাশআল্লাহ হোক নাটক আমাকে করতেই হবে। উনি কিছু বলার আগেই আমি উনার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলাম। এই হাসি আর থামালাম না। ঘড়ি ধরে পাঁচ মিনিট হাসলাম। দেখলাম ছেলেটা কিছুই বলে না। হাসি শেষ করতেই বললো ~ আপনার হাসিটা অন্যরকম সুন্দর।
~ হ্যাঁ, অনেক সুন্দর তাই না? আরেকটু হাসি?
~ না থাক। হাসি থামিয়ে একটু কথা বলি। আপনি কি এভাবেই থাকেন সবসময়?
~ হ্যাঁ, সবসময় এভাবেই থাকি।
আমি আবার হেসে চললাম চার থেকে পাঁচ মিনিট। হাসি থামিয়ে বললাম
~ ভালো লাগছে না আমাকে?
~ না খুব সুন্দর লাগছে। আপনার পছন্দের খাবার কি?
~ এই ধরেন কই মাছের সাথে ডিম ফেটিয়ে ঝোল, তারপর নুডুলসের সাথে ঝাল আমের আচার, পান্তা ভাতের সাথে লেবু দিয়ে আচার।
~ আমলকির আচার খেয়েছেন?
~ প্রচুর খেয়েছি। মুড়ির সাথে আর কি!
আবারো হাসি শুরু করলাম মাঝখানে হাসির বিকট আওয়াজ শুরু করলাম।
মোটামুটি আজকের নাটক ভালো হয়েছে বলে নিশ্চিন্তে রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। একটু পড়েই মার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করতে হবে ভেবে মন টা খারাপ হয়েও হলো না। কারণ আজকে সবথেকে ভালো নাটক প্লে করেছি। কি যে খুশি লাগছে আমার!
প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেলো মার খোঁজ নেই, মানে আমার বারোটা বাজাতে আসলো না। ব্যাপার টা বুঝলাম না। ঘুমিয়ে গেসি কিনা নিশ্চিত হওয়ার জন্য নিজের গালে নিজেই চিমটি কাটলাম। উহ! নাতো ঘুমাই নি। তাহলে মা চুপ এখনো আমার রুমে আসে নি। ঘাবলা আছে ভেবে বাহিরে বের হয়ে দেখি শান্তি মনে টিভি দেখছে। আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে আবার টিভিতে মনোযোগ দিল।কি ব্যাপার এটা তো হওয়ার কথা ছিল না।
ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুম আসলো না। পরের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি দুপুর দুইটা বাজে। মা তাও কিছু বলে না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করতেই বলে
~ ছেলেপক্ষ তোমাকে পছন্দ করেছে এবং এই ছেলে তোমাকেই বিয়ে করবে বলেছে। তোমাকে ছাড়া অন্য কোথাও সে বিয়ে করবে না। তোমার মা এজন্যই কিছু বলছে না তোমাকে।
আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায়। আমার নাটক ফ্লপ খেলো। ফাল্গুনীর নাটক ফ্লপ খেলো! ভাবা যায়! এখন আমি কি করবো হায়!
পিছন থেকে মা এসে বললো
~ তুমি কতো বড় নাটকবাজ, তোমার থেকে আমি বড় নাটকবাজ। ছেলেকে আগেই সব বলে রেখেছিলাম আমি যেন তোমার এসব কান্ডে সে কিছু মনে না করে। হাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহাহোহোহোহোহোহো।
মার হাসি শুনে বেঁহুশ আমি!
লেখাঃ Meherun Falguni
Comments (0)