আমার ঊনিশ বছর বয়সী মেয়েটা ছেলের বউ মিরার কাছে গিয়ে বললো "ভাবি, আমার চুলের ক্লিপটা হারিয়ে গেছে, তোমার একটা ক্লিপ দাও না"
তখন মিরা একটা ভেংচি কেটে বললো "রোজ কিছু না কিছু হারাতেই থাকো। এমন করলে সংসার চলবে কিভাবে? ওই তো দু-পয়সা ইনকাম করে তোমার ভাই। তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। আমার শশুরও তো আহামরি কিছু রেখে যান নি যেটা তোমাদের পেছনে খরচ করবো। রোজ রোজ এসব বায়না করা বন্ধ করো"
আমি বারান্দায় বসে চুপচাপ শুনছি আর শাক কাটছি। শাকে পোকা আছে কি-না দেখতে পাচ্ছি না। চশমাটা ভেঙে গেছে। মিরাকে বলেছিলাম, এখনও নতুন চশমা বানিয়ে দেয়নি। যখন ওর সময় হবে দেবে। ছেলে আমার সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যায় আর রাত দশটার দিকে ঘরে ফেরে। একটু সময় বাচ্চাদের দেয়, আবার নিজে টিভি দেখে। বউয়ের সাথেও তো গল্প করার প্রয়োজন হয় তাইনা! সব মিলিয়ে আমার প্রয়োজনগুলো ওকে বলা হয়ে ওঠে না। মিরাকে বললে দু-কথা শুনিয়ে দেয়। তারপর যদি মর্জি হয় তাহলে আমার আর আমার মেয়ের প্রয়োজন মেটায়। অবশ্য মিরাকেই বা দোষ দেই কিভাবে। সত্যিই তো। ছেলে আমার কত কষ্ট করে, সব কি আমাদের পেছনে শেষ করার জন্য! এখন তো ওর বউ বাচ্চা হয়েছে। তাদের খেয়ালও তো রাখতে হবে। আর আমিও তো এমন কোনো পূণ্য করিনি যার ফলস্বরূপ মেয়ের মতো বউমা আশা করবো।
মনে পড়ে গেল আটাশ বছর আগের কথা। বিয়ের পর তিন বছর পেরিয়েছে সবে। তখনও আমার শরীর থেকে নতুন বউয়ের গন্ধ যায়নি। কেউ বাড়িতে আসলে বড়ো করে ঘোমটা টানতাম। মেহেদী দিয়ে হাত রাঙিয়ে রাখতাম সবসময়। পায়ে রূপোর নূপুর, হাত ভর্তি চুড়ি, কানে সোনার ঝুমকো সারাবছর থাকতো। আমার স্বামী আমাকে সাজুগুজু অবস্থায় দেখতে খুব পছন্দ করতেন। প্রসাধনীও ছিল আমার অনেক। কমতি ছিল না কিছুর। যেটা শেষ হয়ে যেত সেটা বেশি করে আনতে বলতাম। যেটা ঘরে থাকতো সেটাও আনতে বলতাম। আমার প্রসাধনী, গয়না, কাপড়চোপড় কখনও কমতো না। আর কার কি আছে সেটা কখনও জানার চেষ্টা করতাম না। আমার যা লাগবে তা দিতেই হবে। কখনো কখনো না দিতে পারলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতাম।
ঘরে কিশোরী ননদ ছিল একটা। নাম ছিল মিষ্টি। সবাই বলতো ওর মুখটাই না-কি মিষ্টির মতো। শুনে আমার খুব হিংসে হতো। আমার কি কম আছে? ওর চেয়ে ফরসা আমি। আমার রূপ দেখে পাগল হয়েই আমার স্বামী বাড়িতে ফিরে আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছা জানান। কোনো রকম চাহিদা ছাড়াই আমাকে এ বাড়ির বউ করে আনা হয়। সে কি এমনি এমনি? রূপ আছে বলেই তো! সেই আমার সামনে যদি এই শ্যামলা মেয়ের প্রশংসা করে হিংসে তো একটু হবেই!
মিষ্টিকে সবাই লক্ষী মেয়ে বলতো। সারাক্ষণ ওর প্রশংসা করতো। এসব আমার মোটেও ভালো লাগতো না। কেন যেন আমি ওকে সহ্যই করতে পারতাম না। ওকে না দিয়ে প্রায়ই খাবার খেতাম। হঠাৎ যদি ও চলে আসতো খাবার লুকিয়ে ফেলতাম। আমার ড্রেসিং টেবিলের ধারে কাছেও ওকে আসতে দিতাম না। ও মাঝে মাঝে শখ করে আবদার করতো আমি যেন ওকে সাজিয়ে দেই। কিন্তু আমার হিংসে হতো। দিতাম না। কখনও যদি ও আমার কোনো জিনিসে হাত দিত আর আমি সেটা বুঝতে পারতাম, চিৎকার-চেচামেচি করে লোক জড়ো করে ফেলতাম।
এভাবে চলতে থাকলো। বছর কয়েক পরে মিষ্টির ক্যান্সার ধরা পড়লো। চঞ্চল ছটফটে মেয়েটি নিস্তেজ হতে শুরু করলো। এখন আর কিছু খেতে চায় না। খেলা করেনা। আমার ঘরে আসে না। সাজতে চায় না। আগের মতো হাসেনা। মায়াভরা মুখটাতে নেমেছে ক্যান্সারের ছাপ। যদি কখনও নিজ থেকে সাজিয়ে দিতে চাই "পরে সাজবো ভাবী, এখন শরীর ভালো লাগছে না" বলে সরে যায়। ওর জন্য আমার একটু একটু কষ্ট হতে লাগলো।
ওর মৃত্যুর সময় ও এক হাতে আমার শ্বাশুড়িকে অন্য হাতে আমাকে ধরে রেখেছিল। ক্ষীণ গলায় বলেছিল "দেখেছো ভাবী আমি একদম ভালো হয়ে গেছি, তোমাকে একটুও জ্বালাই না"। কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম আমি।
শ্বাশুড়ির হাতে পানি খেয়ে মিষ্টি শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লো। আমি কেন যেন তখন কিছু বলতে পারছিলাম না। স্বর আটকে ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ আমার গলা টিপে ধরে রেখেছে যাতে শব্দ করতে না পারি। আমার শ্বাশুড়ি চিৎকার করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন " এইবার তুমি খুশি তো বউমা? তোমার কাছে আর আমার মেয়ে কিছু খেতে চাইবে না। তোমার শাড়ী পরতে চাইবে না। তোমার গহনায় হাত দেবে না। এবার এ বাড়ির সবকিছু তোমার একার। তোমার আর কোনো অংশীদার নেই এখন থেকে"
শ্বাশুড়ির সেই বুকফাটা আর্তনাদ আর নিজের অপরাধবোধ থেকে যে অনুশোচনার জন্ম নিয়েছিল তার জন্য অনেক রাত ঘুমাতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই মিষ্টির চেহারাটা দেখতে পেতাম। ওর মায়াভরা চোখের করুণ চাহনি দেখতে পেতাম। চিৎকার করে উঠতাম। ওর প্রতি নিজের অবিচারগুলো মানতে পারছিলাম না।
আজ প্রকৃতি হয়তো তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। প্রকৃতির নিয়মই তো এটা, যেটুকু করবে সেটুকু ফিরে পাবে। আজ নাহয় কাল।
মিষ্টি, আমাকে ক্ষমা করে দিস বোন। বেঁচে থাকতে তো তোর কাছে ক্ষমা চাইতে পারলাম না। ওপারে সুযোগ পেলে ক্ষমা চেয়ে নেবো।
লিখাঃ Asma Aktar Urmi
Comments (0)