Search

গল্প: পরিবর্তন

  • Share this:

'মা, ফ্রিজে তো মুরগির গোশত আছে। ওটা দিয়ে একদিন চিকেন বিরিয়ানি করি?'

আমার কথা শুনে মা রাগত্ব স্বরে বললেন, 'তোর ছোট ফুফু বেড়াতে আসার কথা তাই ওইটুকুন গোশত রেখে দিয়েছি। না হলে খাওয়াবি কী! টেনেটুনে চলা সংসারে তিনবেলা ভাতটাই যথেষ্ট, বিরিয়ানির দরকার নেই আর।'

আমি মাথা নিচু করে বললাম, 'তাহলে একদিন ডিম দিয়ে বিরিয়ানি করি?'

'বাসায় পোলাও চাল নেই। এসব বিরিয়ানি খাওয়ার দরকার নেই, কাল সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে দিব তাই খাস।' এবার বেশ শান্ত গলায়ই কথাটা বললেন মা।

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে চুপচাপ চলে এলাম রুমে। ফোনটা হাতে নিয়ে বান্ধবীদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে একবার উঁকি মারতেই দেখি আজকের ইফতারিতে কার বাসায় কী তৈরি হচ্ছে তার বিশাল তালিকা।

ফেসবুকের নিউজফিড জুড়েও ওদের বাসার গতকালের ইফতারির ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে। সেসব ছবির টেবিলে কত কত খাবার সাজিয়ে রাখা। ফেসবুক স্টোরিতেও একই অবস্থা। আমি ছবিগুলোতে লাভ রিয়াক্ট দিয়ে ফেসবুক থেকে বের হয়ে চুপ করে বসে রইলাম।

সেহেরিতে বান্ধবী তিয়াশা আর মালিহার পোস্ট করা বিরিয়ানির ছবি দেখেই বিরিয়ানি খাওয়ার স্বাদ জাগলো। পরিবারের অবস্থা আমি বুঝি। তবুও ইচ্ছেটা চেপে রাখতে পারিনি। মাকে জানিয়েই দিলাম।

বিরিয়ানি আমার ভীষণ পছন্দ। শুধু আমার একার নয়, বাসার সবারই পছন্দের। আমার ধারণা পছন্দের জিনিস যখন তখন চাইতেই পেয়ে গেলে সেটার প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। পছন্দের জিনিস যত কম পাওয়া যায়, খাওয়া যায় ততই যেন আকর্ষণ তীব্র হয়। এই জন্যই বোধহয় বিরিয়ানি আমার এতোটা পছন্দ।

বান্দবীদের চ্যাটবক্সে যখন কেউ আমার বাসার ইফতারি সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আমি বুদ্ধি করে সে প্রশ্ন বিভিন্ন অজুহাতে এড়িয়ে যাই। বান্ধবীদের বাসার এতো এতো ইফতারির ভীড়ে নিজের বাসার চিনির শরবত, খেজুর, চিড়া গুড় আর ছোলা মুড়ির কথা আড়াল করতে পারলেই যেন স্বস্তি পাই।

স্বল্প বেতনে একটা দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন বাবা৷ আমাদের তিন ভাইবোনের পড়াশোনাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় বাবা'কে। বেশ হিসেব করেই সংসারে খরচে করেন মা৷ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে স্বাদ আহ্লাদ বলে কোনো শব্দের বাস থাকে না, থাকে অতীব জরুরী শব্দটার বসবাস৷ টানাপোড়েনের সংসারে অভাব যেখানে নিত্যদিনের সঙ্গী, সেখানে স্বাদ আহ্লাদ হাস্যকর বিষয়।

ছোট ভাইটা এসে মা'কে বললো, 'মা, আমরাও কী প্রতিদিন বেগুনি, আলুর চপ, পিঁয়াজু ভাজতে পারি না? রাজুদের বাসায় রোজ ভাজে। আমাকে এসে গল্প শোনায়।'

'তেলের দাম কত জানিস? রোজ এসব ভাজতে কত তেল খরচা হয় বুঝিস! দেখি একদিন ভেজে খাওয়াব। রোজ রোজ এসব বায়না চলবে না কিন্তু।'

মন খারাপ করে চলে গেলো ছোট ভাইটা। আমি গিয়ে পাশে বসে ওর মাথায় সান্ত্বনার হাত বুলাই। সংসারের অভাব মানুষের মনেও অশান্তির সৃষ্টি করে, সহনশীলতা তখন খুব কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মায়ের মনের অবস্থা আমি বুঝি।

কয়েক বছর আগেও আমাদের সংসারে শান্তি বিরাজ করেছিলো। ব্যবসায় লোকসানে পড়ে সব খুঁয়াতে হয় বাবাকে। তারপর থেকে এই টানাটানিতে চলছে দিন যাপন। এসব ভাবলে ভীষণ মন খারাপ হয়, তাই ভাবাই বাদ দিয়েছি এখন।

কয়েকদিন বাদেই বান্ধবী তিয়াশার বাসায় ইফতার পর্টির আয়োজন। আগে থেকেই দাওয়াত দেওয়া হয়েছে সকল বান্ধবীদেরকে। দাওয়াত পাই আমিও। না যাওয়ার শক্ত বাহানা খুঁজতে থাকি মনে মনে। পরিবারের সবাইকে রেখে এতো ভালো ভালো খাবার আমার পেটে হজম হবে না, এই কারণেই না যাওয়ার অজুহাত খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।

ছোট বোনটা পাশে এসে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, 'আপা তোর কী মন খারাপ?'

আমি মাথা নেড়ে বললাম, 'না। মন খারাপ না। তবে দুশ্চিন্তায় আছি।'

'কীসের চিন্তা?'

'আচ্ছা ধর, তোকে কেউ দাওয়াত দিয়েছে তার বাসায়। কিন্তু তুই যেতে চাচ্ছিস না আবার তাকে সেটা বলতেও পারছিস না৷ তখন তুই কী করবি?'

'চিন্তার বিষয়। তবে আরকিছু না করতে পারলেও ফোনটা বন্ধ করে চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকতে পারব। পরে ভেবে চিন্তে একটা কারণ দাঁড় করিয়ে দিব।'

ওর বুদ্ধিটা বেশ পছন্দ হলো। খানিকটা নিশ্চিন্ত লাগছে এবার।

দেখতে দেখতে কাঙ্ক্ষিত দিন চলে এলো। আজ সন্ধ্যায় তিয়াশার বাসায় ইফতার পার্টি। শক্তপোক্ত অজুহাত খুঁজে না পেয়ে ছোট বোনের বুদ্ধি অনুযায়ী সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোনটা বন্ধ করে রাখলাম। স্বস্তি পাই মনে, বান্ধবীরা এবার কেউ আমাকে ফোনে পাবে না৷

ইফতারিটা রোজ বাবা দোকানেই সারেন।খেজুর, লেবুর শরবত, গুড় ও চিড়া ভেজানো, টুকরো আলু দিয়ে ছোলা ভাজা সঙ্গে মুড়ি সামনে নিয়ে বসে আছি আমি, মা এবং ছোট ভাইবোন দু'টো। হঠাৎ দরজায় এক নাগাড়ে কড়া নাড়ার আওয়াজ শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলাম দরজা খুলতে।

দরজা খুলে দিতেই তিয়াশা, মালিহাসহ একের পর এক সব ক'জন বান্ধবী ধড়ফড় করে প্রবেশ করলো বাসার ভেতর। সবার হাতেই বিভিন্ন রকমের প্যাকেট। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তিয়াশার দিকে।

তিয়াশা হেসে বললো, 'তুই ছাড়া ইফতার পার্টি জমে নাকি! তাই চলে এসেছি।'

মালিহা অভিমানের সুরে বললো, 'কী ভেবেছিস ফোন বন্ধ করে রাখলেই আমরা তোকে আর খুঁজে পাব না?'

তিয়াশা প্যাকেটগুলো মায়ের হাতে দিয়ে বললো, 'আন্টি আজানের খুব বেশি বাকি নেই। আপনি এগুলো সাজিয়ে দিন৷ আজ আমরা সবাই মিলে আপনাদের বাসায় আপনাদের সঙ্গে ইফতার করব।'

মা আনন্দিত চেহারায় সবগুলো খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিতে লাগলেন। সবাই বসে পড়লো। বিরিয়ানি দেখতেই ছোট ভাইটা খুশিতে বলে উঠলো, 'আপা দ্যাখ বিরিয়ানি!'

আমি এখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।

মালিহা আবার অভিমানের স্বরেই বললো, 'স্বার্থপর একটা। ফোন বন্ধ করে রেখেছে। ভেবেছে, রেহাই পেয়েছে। আমরা আর ওকে খুঁজব না!'

বান্ধবীদের এতো ভালোবাসায় চোখের কোণে জল জমেছে আমার। হেসে বললাম, 'আজান দিবে এখনই। আর ঝগড়া করিস না।'

ইফতার শেষে সকলে বিদায় হলো। একটা প্রশ্ন তবুও মনে রয়ে গেলো। রাতে ফেসবুকে যেতেই খটকা লাগে মনে। আজ আর নিউজফিডে কোনো বান্ধবীর কোনো খাবারের ছবি ভাসছে না। ঘটনা বুঝতেই একে একে সকলের আইডিতে গিয়ে টাইমলাইন চেক করতে আরও অবাক হলাম। খাবারের ছবির বিগত পোস্টগুলোও আর কারো টাইমলাইনে নেই। সব উধাও।

তবুও বুঝতে পারছি না এসবের আসল কারণ। কিছুক্ষণ বাদেই তিয়াশার করা একটা পোস্টে চোখ আটকালো আমার।

আমার ছোট ভাইবোনের সঙ্গে তিয়াশা একটা সেল্ফি আপলোড দিয়ে ক্যাপশনে লিখেছে, 'একটা সুন্দর দিন এবং সুন্দর চিন্তার শুরু এখান থেকেই। দিনটা নিজেকে আরও একটু পরিবর্তনের।'

আরও স্পষ্টভাবে বুঝতেই ছুটে গেলাম ছোট ভাইবোন দু'টোর কাছে।

প্রশ্ন করতেই ছোট বোনটা নিচু স্বরে জবাব দিলো, 'হ্যাঁ, আপা। আজ দুপুরে বাবার ওখানে যাওয়ার সময় রাস্তায় তিয়াশা আপার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তখন অনেক কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনি বলতে নিষেধ করেছিলেন। তাই বাসায় এসে কাউকে বলিনি।'

আমি চুপ করে রুমে চলে এলাম। ফোনটা হাতে নিয়ে তিয়াশার পোস্টে একটা লাভ রিয়াক্ট দিয়ে কমেন্ট বক্সে ঢুকতেই দেখি অনেক কমেন্ট জমা পড়েছে।

'কার কখন কোথায় কিভাবে পরিবর্তনের শুরুটা হবে আমরা আসলেই কেউ জানি না। আমাদের এই পরিবর্তনটা সবার মাঝেই আসুক, এই কামনা।' মালিহার কমেন্টটা মন কাড়লো।

আমি কমেন্ট বক্সে টাইপ করতে শুরু করলাম, 'একটা সুন্দর দিন উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ এবং পরিবর্তনের এই সুন্দর রাস্তায় স্বাগত।'

 

লেখা: মাহফুজা রহমান অমি

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।