মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেট ফুকাচ্ছি। আচমকা সামনে এক রসগোল্লা মুখো অপরিচিতার আগমন।
অপরিচিতাঃ ছিঃ! ছিঃ! আপনি সিগারেট খান?
আমিঃ আমাকে বলছেন?
অপরিচিতাঃ হ্যাঁ, আপনাকেই। তা নয়তো এখানে আর কেউ সিগারেট খাচ্ছে নাকি?
আমিঃ ওহ! তাইতো আমাকেই বলছেন তারমানে। তবে খাবার জিনিস খাবো না কেন?
একথা বলার সাথে সাথেই মেয়েটার রসগোল্লার মতো গোল গাল চেহারাটা লাল হয়ে গেল আর সাথে সাথে তার চোখ দুটোও রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেল। আমি অবাক দৃষ্টিতে রসগোল্লা মুখোর দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু সেই রসগোল্লা মুখো আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে আমার দুই ঠোঁটের ফাক থেকে ১৫ টাকায় কেনা বেনসন সিগারেটটা মাটিতে ফেলে দিল। এবারে আমি রেগে মেগে মেয়েটার রসগোল্লার মতো নাদুসনুদুস গালের উপর আমার পাথর মার্কা হাতের ৩ টা আঙুলের ছাপ ফুটিয়ে দিলাম এক চটকনায়। মুহূর্তেই রসগোল্লা মুখোর চোখ থেকে রসগোল্লার রসের ন্যায় পানি টপকে টপকে তার নাদুসনুদুস গাল বেয়ে পড়তে লাগল।
যাইহোক, মেয়েটির কান্নায় একটা অস্থির লেভেলের মায়া আছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে মায়ায় ভাসতে লাগলাম। কিন্তু মেয়েটি কি যেনো বিড়বিড় করতে করতে মুহুর্তেই স্থান ত্যাগ করল। কিন্তু আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। সত্যি বলতে অনুশোচনায় ভুগছি রসগোল্লার মতো চুপসে পড়া নাদুস-নুদুস গালটার উপর আমার এই অন্যায় প্রহারের কারনে।
মিনিটি পাঁচেক এখানেই দাঁড়িয়ে অনুশোচনা করতে লাগলাম। তবে হঠাৎ করে পিছন থেকে আমার কাধের উপর কে যেনো হাত রাখল, আমি দেরি না করে পিছনে ফিরে তাকালাম। কিন্তু তাকানো মাত্রই আমার চমকে যেতে এক মুহুর্তও সময় লাগলো না। কারন কাধে হাত রাখা ভদ্র মহিলাটি হচ্ছে স্বয়ং আমার মা আর তারচেয়ে অবাক করা বিষয় হল, মায়ের হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে সেই রসগোল্লা মুখো মেয়েটি। আমি আমতা আমতা করে বলতে লাগলাম,
- মা, তুমি এখানে?
মাঃ হ্যাঁ বাপজান, আমি এখানে।
আমিঃ কিন্তু কেন?
মাঃ তুই রুপাকে মেরেছিস কেন?
আমিঃ কি বল? রুপা কে? আমি কেন মারতে যাবো? (এতক্ষণে আমি বুঝে গেছি রসগোল্লা মুখো মেয়েটির নাম আসলে রুপা)
রুপাঃ আন্টি, ও মিথ্যা কথা বলছে। ও আমাকে মেরেছে ওকে সিগারেট খেতে বারন করেছি বলে।
মাঃ ও আচ্ছা, তারমানে আমার কাছে থেকে রসগোল্লা খাবার নাম করে টাকা নিয়ে এসে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে! আজকে থেকে তোর হাত খরচ বন্ধ। আর দু-একদিন পর পর যে রসগোল্লা খাবার জন্য আমার থেকে টাকা নেস সেটাও বন্ধ।
আমি কিছু বলতে পারছি না কি বলব। আমতা আমতা করতে লাগলাম।
মাঃ আমতা আমতা করে লাভ নেই। আজকে বাসায় আয়। বাকী কথা বাসায় হবে।
এসব বলেই মা চলে গেল। কিন্তু আমি আর বাসায় যাবার সাহস পেলাম না। রসগোল্লা মুখো মেয়েটার প্রতি জন্মানো সব অনুশোচনা আর মায়া আমার রাগে পরিনত হতে লাগল। কিন্তু রাগ নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই। হঠাৎ ক্রীং ক্রীং করে পকেটে থাকা মুঠোফোনটা বেঁজে উঠল। আর কেউ না আমার মা কল করেছে। আমি ভয়ে ভয়ে কলটা রিসিভ করলাম।
মাঃ কোথায় তুই? মাঠের কোণের মিষ্টির দোকান থেকে তোর আব্বুর নাম বলে ২ কেজি রসগোল্লা কিনে নিয়ে আয়।
আমি রসগোল্লা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। পরেরটা ইতিহাস। মা আমাকে দীর্ঘ এক ঘন্টা আমার প্রিয় পড়ার টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দাড় করিয়ে রেখেছে। আর অন্যদিকে সেই রসগোল্লা মুখো মেয়েটি, যার কারণে আজকে মায়ের কাছে আমি এত বড় অপরাধী হয়ে আছি, সেই মেয়েটি একের পর এক রসগোল্লা নিজের রসগোল্লা মুখো মুখের ভিতর টপাটপ ঢুকিয়ে নিচ্ছে।
যাইহোক, দেড় ঘন্টা এভাবে কাটানোর পর আমার মায়ের মনে আমার জন্য দয়ামায়ার সৃষ্টি হয়েছে। আমার জন্য শর্ত প্রযোজ্য করা হয়েছে, প্রয়োজনের অধিক হাত খরচের টাকা আমাকে দেওয়া হবে না। তবে আমার যেহেতু রসগোল্লা পছন্দ, সেহেতু ফ্রীজ ভর্তি রসগোল্লা সবসময় রাখা হবে, সে নিয়ে চিন্তা নেই।
আমি সব শর্ত বিনা দ্বিধায় মেনে নিলাম। অতঃপর আমার মুক্তি মিলল। মুক্তি পেয়ে প্রথমেই আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই মেয়েটা কে?
মাঃ এই মেয়েটাকে এখনো চিনিস নি তুই? এটা তোর আনিকা আন্টির মেয়ে রুপা। এই যে, তোর সুন্দর গালের মাঝে যে অসুন্দর দুইটা খামছির দাগ, এগুলো তো ওরই দেওয়া। তুই ছোটবেলায় ওর রসগোল্লা খেয়ে ফেলেছিলি তাই তোকে খামছে দিয়েছিল।
মায়ের কথা শুনে রুপা খিকখিক করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমার ইচ্ছে করছে ওর গলাটা চেপে ধরি এক্ষুণি। ছোটবেলায় আমার নরম গালটাকে খামছে খেয়েছে আর বড় হয়ে আমার হাত খরচ বন্ধ করে দিয়েছে। যাইহোক, দু-চারদিন পর রুপা চলে গেল।
তবে আমার জীবনটা ফেলে গেল অসহনীয় যন্ত্রণার মাঝে। সীমিত পরিমাণে হাত খরচ দিয়ে আমাকে পাঠানো হয় ভার্সিটিতে আর বিকাল বেলায় এটা খাবো, ওটা খাবো বলে কিছু টাকা হাতিয়ে নেবার চেষ্টা করলে আমার মুখে গুজে দেওয়া হয় গোল গোল রসগোল্লা।
যাইহোক, সবশেষ আমার এই অসহনীয় যন্ত্রণার জীবনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে ঠিক ২ বছর পর, অনার্স কমপ্লিটের শেষে। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি নিশ্চিত হয়েছে আজই। অফিসের বস বলেছে কাল থেকে চাকরিতে যোগ দিতে, আর সে সুবাদে অফিসের সবাইকে রসগোল্লা খাওয়াতে।
বসের কথা মতো রসগোল্লার প্যাকেট হাতে নিয়ে অফিসে গিয়ে সবাইকে রসগোল্লা বিতরণ শুরু করলাম। সবার পরে অফিসে আসল বস। তাই সবশেষে বসকে রসগোল্লা খেতে দিলাম প্যাকেট ধরে। বস প্যাকেটটা খুলে সেখান থেকে রসগোল্লা বের করে মুখে দিবে ওমনি একটা মশা কোথায় থেকে এসে যেনো পরল রসগোল্লার উপর। কিন্তু বস সেই মশাটা দেখতে পেল ক্ষানিক সময় পরে। সেখানেই সব বিপত্তি। তার ধারনা আগে থেকেই মশা ছিল এই রসগোল্লার মধ্যে। অথচ, আমি নিজের চোখে দেখলাম মশাটা উড়ে গিয়ে পড়ল সেটার দিকে স্যার কর্ণপাতই করলেন না। উনি আমার নিয়ে আসা রসগোল্লাকেই দোষারোপ করতে লাগলেন। কাজেই এই রসগোল্লার সুবাদে প্রথম দিনেই আমাকে বসের কাছে মুখ ঝামটা খেতে হল।
যাইহোক, মাস খানেকের মধ্যেই দক্ষতা দিয়ে স্যারের মন জয় করে নিতে পেরেছি। প্রথম মাসের বেতনটা পেয়ে মায়ের হাতে বেতনটা তুলে দিতেই মা খুশিতে টগবগ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, তার এখন বৌ মা লাগবে। সহজ ভাষায়, আমাকে এখন বিয়ে করাবে সে। বিয়েতে অবস্য আমার অসম্মতির কোনো কারণও নেই। ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন পরীর মতো একখানা মাইয়া বিয়ে করমু।
আর সেখানে রুপা বোধয় পরীকেও হার মানাবে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। আমার বউ হিসাবে সেই রসগোল্লা মুখো মেয়েটাই বেছে নিয়েছে মা। আর আমিও এক পায়ে দাঁড়িয়ে হ্যাঁ সূচক মনোভাব জানিয়ে দিয়েছি৷ অতঃপর রসগোল্লার সাথে না মানে, রুপার সাথে ধুমধাম করে আমার বিয়ে হলো। রসগোল্লার মতোই মিষ্টি আমারদের সংসার, রসগোল্লার রসের ন্যায় ভালবাসায় ভরপুর।
ইতিমধ্যে বিবাহ উপলক্ষে অফিস থেকে বার্ষিক ছুটি পেলাম টানা ১৮ দিন। সিদ্ধান্ত নিলাম, শ্বশুর বাড়ি যাবো বেড়াতে। রুপার থেকে জানতে পারলাম, নতুন জামাইদের নাকি রসগোল্লা নিয়ে যেতে হয়। এটা নাকি তাদের গোষ্ঠীর নিয়ম। তাই আমি ১০ কেজি রসগোল্লার সাথে বেশ কিছু ফলমূল নিয়ে রওনা দিলাম শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে। আমরা খুব ভালভাবেই এখানে এসে পৌঁছালাম।
কিন্তু সমস্যা বাধল সেই রসগোল্লায়। রসগোল্লার প্যাকেটগুলো আমরা সিএনজিতেই ফেলে রেখে এসেছি মনের ভুলে। ফল-মূল যে পরিমাণ এনেছি তাতে মানসম্মান চলে যাবার কথা না। তবে আমার শ্বশুরবাড়ির চৌদ্দ গোষ্ঠীর নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে বলে সকলেই অখুশি। নতুন করে ২০ কেজি রসগোল্লা নিয়ে আসার পরেও তাদের নিয়ম রক্ষা আর হয়নি। নতুন জামাই নাকি রসগোল্লা সমেত বাসায় ঢুকবে সেটাই নিয়ম। আমিই প্রথম জামাই যে কিনা তাদের বংশের নিয়ম ভাঙলাম।
যাইহোক, এক সপ্তাহ শ্বশরবাড়িতে জামাই আদর খেয়ে বাসায় ফিরলাম ভালভাবেই। তারপর রুপাকে নিয়ে এক এক জায়গায় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই কেটে গেল ছুটির বাকী দিনগুলো। আজকে আবার অফিসে যোগ দিয়েছি, সঙ্গতকারণে অফিস আজকে দুপুর ১২ টায় ছুটি দিয়েছে। কালকে রুপা রসগোল্লা খেতে চেয়েছিল তাই অফিস শেষে এখন যাচ্ছি রসগোল্লা কিনতে। হঠাৎ রাস্তায় কলেজ লাইফের এক বান্ধবী তন্নির সাথে দেখা। আমাকে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছি। জবাবে আমি বলললাম রসগোল্লা কিনতে। জবাব শুনে পিপীলিকার মতো ও আমার পিছে ছুটতে লাগল, রসগোল্লা খাবার উদ্দেশ্যে। কলেজে থাকতে আমরা এরকমই করতাম, ও বোধয় অভ্যাসটা বদলাতে পারেনি। কলেজে থাকতে এড়িয়ে গেলেও চাকরির সুবাদে আজ আর ওকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না।
রসগোল্লার দোকানে এসে দোকানদারকে রসগোল্লা প্যাকেট করতে বলে আমরা দুইটা প্লেটে ৪ টা রসগোল্লা নিয়ে বসে বসে খেতে লাগলাম। কিন্তু তারপর যা হল, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আচকা আমার রসগোল্লা মানে রুপার আগমন এই রসগোল্লার দোকানে। আমাদের দুজনকে একসাথে রসগোল্লা খেতে দেখে ওর চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেল, আর ও চেঁচাতে লাগল, এই তোর অফিস? এখানে এসে মেয়েদের নিয়ে রসগোল্লা খাচ্ছিস? আমি এক্ষুণি গিয়ে মাকে সব বলবো।
আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে রুপা চলে যেতে লাগল দ্রুত গতিতে আর আমি ওর পিছু ছুটতে ছুটতে চেঁচাতে লাগলাম, ঐ দাঁড়াও। ঐটা আমার বান্ধবী তন্নি। তুমিই তো আমার একমাত্র রসগোল্লা। আমি আর জীবনেও রসগোল্লা খাইতাম না, রসগোল্লা কিনতামও না। আমার জীবনে একটাই রসগোল্লা, সেটা তুমি। আমার কথা শুনে রুপা মিটমিট করে হাঁসছে বুঝতেই পারছি। এখন রাগ করার মিথ্যা নাটক করছে বুঝাই যাচ্ছে।
এভাবে ছুটতে ছুটতে দুজনেই বাসায় চলে আসলাম। তবে বাসায় ঢুকে যা দেখলাম, সেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা বাসায় পৌঁছানোর আগেই তন্নি রসগোল্লার প্যাকেট নিয়ে আমাদের বাসায় পৌঁছে গিয়ে মায়ের সাথে বসে বসে রসগোল্লা খাচ্ছে।
এবারে বুঝছি, আমি এই রসগোল্লাকে ছাড়লেও রসগোল্লা আমাকে ছাড়বে না কখনো।
- সমাপ্ত
Writer: Nil Ahmed (Sakib)
Comments (0)