ইফতারিতে শরবত মুখে দিয়েই ছোট ভাই বলে উঠলো, 'মা, প্রত্যেকদিনই তো শরবতে চিনি কম হয়।'
আমি অভিযোগের স্বরে বলে উঠলাম, 'ছোলা কি পানি দিয়ে ভাজো মা? তেল তো দেখাই যায় না কোনোদিন। আর ছোলার মধ্যে তো আলুই বেশি দাও তুমি। তবুও পরিমাণে এত কম ভাজো যে এই কয়টা মুড়িও মাখাতে পারি না।'
মা হাসি হাসি মুখ করে বললেন, 'কই! সবই তো ঠিক আছে। কী যে বলিস না তোরা!'
বিরক্তি নিয়ে বললাম, 'রোজই সব বেঠিক থাকে। আর রোজই তুমি এভাবে বলো সবই ঠিক আছে। এভাবে রোজ খেতে খেতে এতেই তুমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছো। আর এখন ভালো মন্দের তফাৎটাই ভুলে গেছো।'
মা চুপ করে রইলেন। খাওয়া নিয়ে যত অভিযোগ আমার আর ছোটুর। বাবা কিংবা মা কখনো কোনো খুঁত যেন খুঁজেই পান না৷ তাদের চোখেই পড়ে না।
ইফতারিতে আমাদের বাড়িতে খাবারের ধরন খুবই কম থাকে। সব সস্তা আর সহজলভ্য খাবার দিয়েই মা প্রতিদিন ইফতারিটা চালিয়ে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন৷
সেদিন ছোট ভাইটা আবদার করে বলেছিলো বেগুনি খাবে। বেশ কয়েকদিন বলার পরে বাবা বাজার থেকে একটা ছোট দেখে বেগুন নিয়ে এসেছিলেন। মা বেগুনি ভেজেছিলেন। তবে সেখানে বেসনের থেকে চালের গুঁড়ার পরিমাণই অধিক৷ নব্বই শতাংশ চালের গুঁড়া আর দশ ভাগ বেসন। অথচ হওয়ার কথা ছিলো উল্টো। অভিযোগ থাকলেও আমরা সকলে সেই বেগুনি সেদিন খেয়েছিলাম মজার খাবার মনে করে।
বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা দোকানে ইফতার উপলক্ষে নানান রকমের খাবার বিক্রি করা হয় প্রতিদিন। জিলাপি, নানান রকমের চপ, গ্রিলড চিকেন, কাবাব, হালিমসহ আরও অনেক কিছু৷ শুনেছি ওগুলোর ভীষণ দাম৷ তাই আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা ওসব থেকে দূরেই থাকে।
কয়েকদিন যাবৎ খুব তেল পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে৷ মা'কে বললাম সে কথা৷ মা বললো, ঠিক আছে।
ফ্লোরে বিছানো পাটিতে খুশি খুশি মুখ নিয়ে ইফতারের সময় বসতেই মা চিতই পিঠা এনে দিলেন সামনে। খুশি মুখখানা চুপসে গেলো আমার।
মলিন মুখে মা'কে বললাম, 'বলেছিলাম তো তেল পিঠার কথা।'
মা শান্ত গলায় বললেন, 'তেলের জিনিস ইফতারে না খাওয়াই ভালো। ক্ষতি হয়। এর থেকে চিতই পিঠা খা তরকারি দিয়ে, শরীরে উপকার হবে।'
আমি চুপ করে খেয়ে উঠলাম। মা সবসময় এমন কেন করে বুঝি না৷ ভেতরে খুব রাগ হয়। সবাই ভালো ভালো খাবার খায়, সবার বাড়িতে সুন্দর করে রান্না হয়৷ অথচ আমাদের বাড়িতে যেন রান্না না হলেই বেঁচে যেতেন মা৷
সকালে ঘুমিয়ে আছি এমন সময় মা এসে ডাকাডাকি শুরু করলেন৷ আমি চোখ ডলতে ডলতে বললাম, 'কী হয়েছে? ডাকছো কেন?'
'তোর বাবা আজ সন্ধ্যার পরে ফিরবে। বাড়িতে কোনো বাজার-সদায় নেই। টাকা দিলে তুই আর ছোটু গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসতে পারবি?'
আমি নিশ্চিন্ত মন নিয়ে বললাম, 'এ আর এমন কী কাজ! পারব না কেন?'
আমি আর ছোটু বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বেশকিছু টাকা দিয়েছেন মা হাতে। অথচ লিস্টে জিনিসের পরিমাণ কত কম! আজকে সব বেশি বেশি করে কিনে নিব সঙ্গে পছন্দের জিনিসও কিনব ভেবে মনে মনে বেশ আনন্দ পাচ্ছি।
ছোটু বললো, 'আপা আজ আমরা ওই দোকান থেকে হালিম কিনে নিয়ে যাব সঙ্গে জিপালিও।'
আমি হেসে বললাম, 'ঠিক আছে।'
বাজারে প্রবেশ করলাম।
ছোটু বললো, 'আপা, আগে লিস্টের জিনিসগুলো কিনে নিই।'
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। বেশ কয়েক মাস ধরে বাজারে আসা হয় না৷ তাই সম্প্রতি বাজার দর সম্পর্কে ধারণা নেই। তবে এতটুকু বুঝতে পারছি মা যে টাকা দিয়েছেন তাতে করে ভরপুর বাজার করে বাড়ি ফিরতে পারব।
লিস্ট ধরে দোকানে গিয়ে জিনিসপত্রের দাম জিজ্ঞেস করতেই চোখ কপালে উঠলো আমার। এ দোকান ও দোকান ঘুরেও লাভ হলো না। সব দোকানেই একই অবস্থা। লিস্টের জিনিসগুলো সব ঠিকঠাক কিনে বাড়ি ফিরতে পারব বলে মনে হচ্ছে না৷
হতাশ মনে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। এক মধ্যবয়স্ক মহিলা দোকানদারের উদ্দেশ্যে বললেন, 'তেলের যা দাম। পানি দিয়েই রান্নাবান্না করতে হবে যা দেখতেছি।'
মহিলার কথা শুনে মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আমি সামনে হাঁটতে লাগলাম।
পাশ থেকে এক বয়স্ক লোক যেতে যেতে বলে উঠলেন, 'আমাগো মতো মানষেরা রমজান মাসে দুই বেলা একটু পেট ভইরা খাইব, তারও উপায় নাই। এত দাম বাড়ায়ে দেয় এরা, চিন্তায়ই তো পেট ভইরা যায়। খামু আর কী!'
কথাগুলো কানে বাজতে থাকলো। কোনোরকমে কেনাকাটা শেষ করে আমি আর ছোটু বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ভাজাপোড়ার সেই দোকানের সামনে আসতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। হালিম কিংবা জিলাপি কিছুই কেনার টাকা নেই হাতে। দোকানটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দুই চাকা, চার চাকার গাড়ি থামিয়ে লোকেরা তাদের পছন্দের খাবার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বেশ ভীড় দোকানে।
আমাদের পাশেই এক মহিলা তার ছোট্ট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন।
মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, 'এগুলো আমাদের জন্য নয়। আমি বাসায় গিয়ে তোমাকে লুচি ভেজে দিব ঠিক আছে? ডাল দিয়ে খেও মজা করে।'
মেয়েটা মাথা নাড়ালো। মহিলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, 'আমাদের মতো মানুষের এগুলো দেখেই যেতে হবে। খাওয়ার সমর্থ হবে কবে জানি না।'
রিকশা এলে তারা চলে গেলো।
ছোটু আমার হাত ধরে বললো, 'চল আপা। বাড়ি যাই।'
আমরা বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করি। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কত কত কথা।
ছোটু বললো, 'আপা রমজান মাস তো রহমতের মাস। ভালো কাজ করার মাস৷ একে অপরকে সহযোগিতা করার মাস। সওয়াব অর্জনের মাস। তাহলে এসব ব্যবসায়ীরা কেন রমজান এলেই সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দেয়? মানুষের প্রতি এত নিষ্ঠুর কীভাবে হয় তারা?'
আমি চুপ করে রইলাম। ছোটুর প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমার মনে হয় যারা এমন কাজ করেন তাদেরও এর উত্তর জানা নেই৷ তারা কখনো এই প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টায় বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন কী না তাও জানা নেই। শুধু জানি তারা সুবিধাবাদী মানুষ। নিজেদের সুবিধার জন্য অন্যকে অসুবিধায় ফেলতে তাদের বাধে না।
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
Comments (0)