- টিউশনি থেকে ফিরতে ফিরতে আমার সেদিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে এলিফেন্ট রোড পুরোপুরি নিরব থাকে। আশেপাশে কোনো রিকশা নেই, নেই কোনো বাস। কিছু করার নাই। তাই হাটতে হাটতে কার্জন হল এর কাছাকাছি আসার পরেই গেটের ভেতর এক কুকুরকে বসে থাকতে দেখলাম। যদিও রাস্তা ঘাটে এইসব নেড়ি কুকুর দেখা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবুও সেই কুকুরটি আট দশটা কুকুরের মতো ছিল না। গোলাপি রং এর কুকুর ছিল। বোধ হয় কেউ গোলাপি রং ঢেলে দিয়েছে কুকুরটির উপর। আমি দ্রুত পা চালাতে লাগলাম। হঠাৎই মনে পরলো কার্জন হলের সামনে তো অন্ধকার ছিল। আমি কুকুরটিকে এই অন্ধকারে দেখলাম কি করে! যাই হোক দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে আমার।
সেদিন আবার আমার ছোট বোন তার জন্য চকলেট কিনে নিয়ে যেতে বলেছিল। তখন বাজে রাত ১১ টা। আশেপাশে কোনো দোকান নাই। এলাকায় বোধ হয় আবুলের দোকান বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। হাটতে হাটতে কিছু দূর যাওয়ার পরেই একটি রিকশা চোখে পরলো। রিকশা ওয়ালা মামা এই শীতের সময়েও রিকশা ওয়ালা মামা খালি একটা পাতলা গেঞ্জি পরে বের হয়ে গিয়েছে। যাই হোক রিকশা ঠিক করে চড়ে বসলাম।
মতিঝিলের কাছাকাছি আসার সাথে সাথেই ঝুম বৃষ্টি পরা শুরু করলো। তখন হঠাৎ রিকশাওয়ালা মামা রিকশা থামিয়ে আমার পাশে এসে বসলো এবং পর্দা মেলে ধরলো। ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলেও পরে জানতে পারলাম তার বৃষ্টির পানিতে এলার্জি। একে অ্যাকুয়োজেনিক আর্টেকেরিয়া বলে। রিকশাচালক মামার সাথে একটু কথা বলার চেষ্টা করলাম। সে শুধু হা হু করে উত্তর দিচ্ছিল। রিকশাচালক মামার গা হতে উদ্ভট এক ধরনের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। আসলে সেটা ঘ্রাণ নাকি গন্ধ বুঝতে পারছিলাম না। কি রকম জানি নেশার মতো। মামার লুঙি ও গেঞ্জি দুইটাই নতুন হওয়া সত্বেও তার এক পায়ে সেন্ডেল ছিল না। বৃষ্টি থামার সাথে সাথে মামা রিকশা চালিয়ে আমাকে আমার বাসার সামনে নামিয়ে চলে গেলো।
হঠাতই মনে পরলো তনু চকলেট কিনে নিয়ে যেতে বলেছিল। আমি ফিরে মোড়ের সামনে আসতে আসতে খেয়াল করলাম আবুলের দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে তার পেছনের দোকানে কিছু লোক চা খাচ্ছে আর গল্প গুজব, আড্ডা দিচ্ছে। আমি সেই রাতেই দোকানটি প্রথম দেখেছিলাম। এর আগে সেটি সেখানে ছিল না। যাই হোক দোকানির কাছ থেকে চকলেট কিনার সময় খেয়াল করলাম দোকানির চেহারা অবিকল সেই রিকশাওয়ালা মামার মতো। তবে এই দোকানি সেই মামার মতো গম্ভির না বরং যথেষ্ট হাসি খুশি এবং দিব্যি এঁটো চায়ের কাপ পানি দিয়ে ধুচ্ছে। আমি যথেষ্ট অবাক। আর, কিছুটা ভয় করছিল আমার। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসা একজন মধ্যবয়স্ক লোক জিজ্ঞেস করলো আমি এই এলাকায় নতুন নাকি! সেইবার আমার মেজাজ প্রচণ্ড রকমের খারাপ হলো। আমার বাবাকে এই এলাকার পিচ্ছি হতে শুরু করে বুড়ো সবাই চিনে। আমাকেও চিনে। আর এই লোক আমার এলাকায় আমাকেই বলছে আমি নতুন নাকি! যাইহোক বিগড়ানো মেজাজের সাথে ভয় এর ছিটেফোঁটা মিলে অদ্ভুত সব অনুভূতি হচ্ছিল আমার সেদিন।
বাসায় ঢুকতে যাবো তখনই দেখি দারোয়ান কাকা কই যেন যাচ্ছে! আমি জিজ্ঞেস করায় সে বলল কিচ্ছুক্ষণ আগে নাকি তার অন্তঃসত্বা স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে। তবে দারোয়ান কাকার মুখে অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতা।
সেই বারই প্রথম আমি এত রাত অব্দি বাইরে ছিলাম। হয়তো এই শহরে এই সময়ে এত রাতে এই রকম অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা ঘটে। তবে আমি আর কথা না বাড়িয়ে উপরে উঠে আসলাম। ঘড়ে ঢুকে দেখি মা বাদে বাকি সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। মাকে বললাম মা তুমি ঘুমাওনি কেনো? মা কিছু না বলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল খেয়ে ঘুমিয়ে পরতে। অবাক হবার বিষয় না যদিও তবে মায়ের মুখেও সেই অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতা। মা ঘুমাতে চলে গেলো। আমি খেয়ে, তনুর রুমে তার পড়ার টেবিলে চকলেট গুলো রেখে এসে, নিজের রুমে চলে আসি।
সচরাচর বারোটা নাগাদ আমি শুয়ে পরলেও সেদিন অনেক রাত হয়ে যাওয়াতে আমার ঘুম আসছিল না। বুক সেল্ফ থেকে একটি বই নিয়ে পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পরলাম টেরই পেলাম না। রাত সাড়ে তিনটা বাজে হঠাতই কোনো শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। শব্দের উৎস খোজার জন্য খাট হতে নামতেই কি যেনো পায়ের উপর দিয়ে দৌড় দিল। এই বাসায় আগে অনেক ইদুর ছিল। কিছুদিন আগে বাবা সব কয়টাকে মারলো। তাহলে তখন আবার ইদুর কোথা থেকে আসলো। বোধহয় সব কয়টা মরে নাই। পানি খেয়ে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পরলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার বিছানা বাদে আশেপাশের সব কিছু পোড়া। আমি অবাক হয়ে দৌড়ে মা-বাবার রুমে গিয়ে দেখি সেখানে কেউ নেই। মনে হচ্ছিল পুরো বাসায় ভয়াবহ ধরনের আগুন লেগেছিল। তনুও ওর রুমে নাই। পুরো রুমই খালি। আমার মাথা ভো ভো করছিল তখন। মাথা ঘুড়িয়ে আমি মেঝেতে পরে গেলাম। সেদিন দুপুর নাগাদ। চোখ খুলেই দেখি আমি নিজের রুমে শুয়ে আছি। বাইরে ব্যাপক হৈচৈ। মায়ের ও তনুর কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর সাড়ে বারোটা। দরজা খুলেই দেখলাম বাইরে কেউ নাই। পুরো বাড়িতে আমি একা। তবে আশ্চর্য জনক ব্যাপার হচ্ছে পুরো বাসাই ঠিকাছে। কোথাও আগুনে পোড়ার কোনো চিহ্নটুকুও নেই। আমি দৌড়িয়ে তনুর রুমে গিয়ে দেখি টেবিলের উপর চকলেট গুলো রাখা। কলিং বেলের শব্দ শুনে আমি দরজা খুলেই দেখলাম বাবা মা আর তনু এসেছে। তারা নাকি ছোট খালার বাসায় গিয়েছিল। আমি ঘুমাচ্ছিলাম তাই ডাক দেয় নি।
বাবা বলল আরাফ নিচে রিকশাওয়ালা কে একটি পানির বোতল ভরে দিয়ে আয় তার নাকি পানির পিপাসা লেগেছে। বোতল নিয়ে নিচে গিয়ে দেখি উনি সেই রিকশাওয়ালা যার রিকশা দিয়ে আমি বাড়ি ফিরেছিলাম! আমাকে দেখে সে হাসছে। তার পরনে নতুন গেঞ্জি আর লুঙ্গি।
- আপনার মেবি হ্যালুশিনেশন হয়েছিল ঘুমের মধ্যে।
- বোধ হয়। তবে বাস্তবে রিকশাচালক লোকটির চেহারা কেমন করে মিলে গেলো?
- God knows!
সালমান_সিদ্দিকী
Comments (0)