Search

হৃদেধারিণী মা (ছোট গল্প)

  • Share this:

তরু আমার বাড়িতে বউ হয়ে এসেছে আজ বিশ দিন হলো। আসার পর থেকে নিজেকে কিছুটা আলাদাই রাখছে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়। নিজ থেকে কোনো কিছু বলতে চায় না। সংকোচবোধ করে,হয়তো জড়তা কাজ করছে। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষগুলোকে পুরোপুরি বুঝতে কিছুটা সময় নিচ্ছে। এতে আমার কোনো অভিযোগ নেই। সময় নিয়ে আস্তে আস্তে সবাইকে আপন করে নিক। তবে আমি চাই তরু আমার সাথে আরও মিশুক। ফ্রীভাবে সব সময় কথাবার্তা বলুক। ঠিক আমার মেয়ে তুবার মতো হয়ে যাক। তুবা বাড়িতে থাকলে বাড়িটা সব সময় প্রাণোচ্ছল থাকতো। মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পর বাড়িটা শূন্য হয়ে যায়। সব কিছু খালি খালি লাগে। বাসায় থাকলে কথা,হাসি দিয়ে বাড়িটাকে জমিয়ে রাখতো। কতকিছুর জন্য বকা দিয়েছি। বকা শোনার একটু পরেই গলা জড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলতো। এখন আর কেউ যখন তখন গলা জড়িয়ে গালে গাল মিশিয়ে আহ্লাদি কথা বলে না। ইচ্ছে করলেই এখন আর মেয়েটাকে কাছে পাই না।

মেয়েটারও তার বাবার মতো গাঢ় লিকারের চা, কফির নেশা ছিল। বেশি খেলে বকা দিতাম তাই আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে দুই মগ ভর্তি চা নিয়ে চুপিচুপি বাবার ঘরে চলে যেতো। বাবার সাথে জমিয়ে গল্প করতে করতে কফি গিলতো।

মেয়ের চা খাওয়া নিয়ে কিছু বললেই তুবার বাবা বলতো,

-আমার মা'কে কিছু বলবা না। তার বাবার টাকায় একশো মগ চা খাবে। কারো কোনো সমস্যা আছে?

রাগে কটমট করে বলতাম,

-তোমার আদর পেয়ে মেয়েটা বদ অভ্যাসগুলি ছাড়তে পারছে না। দিনে এতবার কেউ চা খায়? তিনবেলা খাবার না খেয়ে শুধু মগভর্তি চা,কফি গিললেই হবে? তোমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে লোকজন বলবে মা তার মেয়েকে শুধু চা খাওয়া শিখাইছে। আর কিছু খেতে পারে না। একটা মিষ্টির অর্ধেক ভেঙে পানি দিয়ে ধুয়ে খেতে কাউকে দেখেছো? তোমার মেয়ে অর্ধেক মিষ্টি পানি দিয়ে ধুয়ে খায়।

তুবার বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে বললেন,

- ওর ইচ্ছে হয়েছে মিষ্টি ধুয়ে খাবে এতে সমস্যা কোথায় ? দেখে নিও, আমার তুবার ভালো ঘরেই বিয়ে হবে। শ্বশুর,শাশুড়ি তুবাকে খুব ভালোবাসবে।

সত্যিই তুবার বাবার ঐদিনের কথাটা সার্থক হয়েছে। মেয়ে আমার শ্বশুরবাড়িতে খুব সুখে আছে। হাজব্যান্ড, শ্বশুর-শাশুড়ি,দুই দেবর নিয়ে তার কোনো অভিযোগ নেই। শাশুড়িও তুবার মতো গল্প করতে পছন্দ করেন। বউ,শাশুড়ি দু'জনেরই চা-কফির নেশা। দু'দিনের জন্য মায়ের কাছে এসে শ্বশুরবাড়ির গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে। বলে,

" ইচ্ছে হলেই বিকেলে শাশুড়িকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। দু'জনে ঘুরে ঘুরে টুকটাক কেনাকাটা করে আইসক্রিম, ফুচকা, চটপটি খেয়ে বাসায় আসি।

শাশুড়ি মা'কে নিয়ে বাইরে গেলে উনি খুব খুশি হন। বাবা নাকি মায়ের অনেক ইচ্ছাই পূরণ করতেন না। আমি বাড়িতে আসার পর নাকি মায়ের অনেক শখ পূরণ হচ্ছে হিহিহি...."

মেয়ের সাথে সাথে নিজেও হাসলাম। মেয়েকে

সুখী দেখে শান্তি পাই, তৃপ্তি পাই।

মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি একমাত্র ছেলে মাহিকে বিয়ে করাবো। এদিকে ছেলেও এমআইএসটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকুরিতে ঢুকেছে। ছেলেকে বললাম,"তোর জন্য মেয়ে দেখা শুরু করছি। পছন্দ থাকলে জানা আমাদের।" ছেলে ল্যাপটপে চোখ রেখেই জবাব দিল," চাকরিতে ঢুকেছি ছ'মাসও হয়নি এখনি মেয়ে দেখা শুরু করছো? আমার কোনো পছন্দ নেই, তবে আমি এই মুহূর্তে বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত নই। পাঁচ বছর পর বিয়ের কথা বলবা।" বললাম,"তুই প্রস্তুতি নিতে থাক। মেয়ে পছন্দ হলে বিয়ের কাজ শেষ করে ফেলবো,কথাটা মাথায় রাখিস!"

ছেলের আর কোনো কথা না শুনে চলে আসলাম তুবার বাবার কাছে। এসে দেখি চোখের সামনে খবরের কাগজ মেলে ডুবে আছে। এখন কথা বললে কোনো জবাব দিবে না। শুধু হ্যাঁ,হু করবে।

পেপার পড়া শেষ করুক পরে এসে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলবো। ফিরে আসার জন্য পা বাড়ালাম। 'নিরু,কিছু না বলে চলে যাচ্ছো কেন?'

'কি করবো? তুমি তো বসে বসে খবরের কাগজ মুখস্থ করছো। আমার কথা শোনা,ডানে-বামে তাকানোর সময় তোমার আছে?'

খবরের কাগজ উল্টাতে উল্টাতে হেসে উনি বললেন,'কান তো খোলাই আছে। যা বলার বলে যাও, শুনছি।' বললাম,'ছেলেকে বিয়ে করাবো মেয়ে দেখা শুরু করো।' তুবার বাবা আবারও হাসলেন। এরপর বললেন,'ছেলে বিয়ে করাবা ভালো কথা! মাহির সাথে কথা বলে নিও। জেনে নিও ওর কোনো পছন্দ আছে কিনা।'

বললাম,'পছন্দ নেই। জানালো বিয়ের জন্য সে এখন মোটেও প্রস্তুত না।' উনি হাসতে হাসতেই বললেন,'তোমার ছেলে তো বড় হয়ে গেছে দেখছি! ভালোই বলেছে। সবেমাত্র চাকুরিতে ঢুকেছে। এখনি বিয়ের কথা বলছো কেন?' কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললাম, 'তোমরা বাপ-ছেলে প্রস্তুতি নিতে থাকো আমি মেয়ে দেখা শুরু করি'।

প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে সকালে হাঁটতে বের হই। ডান পায়ের গোড়ালিতে ব্যথার কারণে তিনদিন হাঁটতে পারি নি। ছোটকালের বান্ধবী মিনা প্রায়ই ফোন করে বলে,'নিরু আমার বাসায় আসার সময় তো তোর নেই! সকালে হাঁটতে হাঁটতেও তো একদিন স্কুলে চলে আসতে পারিস! স্কুলটাও দেখে গেলি। চা খেতে খেতে প্রাণভরে গল্পও হয়ে গেল। কতদিন দেখি না তোদের!' মিনাকে বললাম,'দেখিস, সোনালিকে নিয়ে যেকোনো দিন তোর স্কুলে হাজির হয়ে যাবো, ইনশাআল্লাহ। অপেক্ষায় থাক।'

মিনা তার হাজব্যান্ড দু'জনেই বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। বিয়ের এতবছরেও মিনা সন্তানের মুখ থেকে 'মা' ডাক শুনতে পারে নি। মিনার সুখী জীবনের কিছু শূন্যতা, দীর্ঘশ্বাস,আক্ষেপ রয়েই গেল। নিঃসন্তান দম্পতি চাকুরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর কিন্ডারগার্টেন স্কুল খোলেন। নিজেরা সন্তানের মা-বাবা হতে পারেনি। স্কুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিজের সন্তানই মনে করে।

একদিন সকালে বান্ধবী সোনালিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিনার স্কুলে গিয়ে ওকে চমকে দেই।

সাথে নিলাম ওর পছন্দের মাংসের ঝাল ঝাল সিঙারা। এতদিন পর প্রিয় বান্ধবীদের কাছে

পেয়ে বুকে জড়াজড়িতে সময় চলে যায় কিছু সময়। মিনা আয়াকে দিয়ে বিশাল নাস্তার আয়োজন করে। গল্পে গল্পে খাওয়ার পর্ব শেষ করে মিনাকে সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে স্কুল দেখছি। বারান্দা ধরে হাঁটার সময় একটা শ্রেণীকক্ষ থেকে কথা ভেসে আসে,'সোনামনিরা,নিজের কাজ নিজেকেই গুছিয়ে করতে হবে। রাতে পড়া শেষ করে স্কুলের ইউনিফর্ম, জুতা,মোজা গুছিয়ে রাখবে। বই-খাতা,পেন্সিল, ইরেজার ব্যাগে ভরে রাখবে। ছোট ছোট কাজগুলি তুমি একাই করার চেষ্টা করবে। এতে করে তুমি ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী হতে শিখবে। নিজের ছোট ছোট কাজ

করার পাশাপাশি মা,বাবার অনেক কাজেই হেল্প করতে হবে। আমি অনেক ছোট থাকতেই মা'কে হারিয়েছি....'

কথা থেমে যাওয়াতে দরজার সামনে দাঁড়ালাম।

দেখলাম, পরনে গোলাপি শাড়ি, ছিপছিপে গড়নের একজন শ্রেণী শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের কথাগুলো বলছেন। হঠাৎ মিনাকে দেখে ছাত্রীরা তড়িঘড়ি করে দাঁড়িয়ে সালাম দিলে ঐ টিচার ঘুরে তাকিয়ে মৃদু হেসে সালাম দিলেন। তখনি তরুর মায়াবী,মিষ্টি মুখটি দেখার সুযোগ হলো। মিনা পরিচয় করিয়ে দিল,'আমার ছোটবেলার বান্ধবী নিরু আর সোনালি।'

তরু হেসে কুশল বিনিময় করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কেন জানি বারবার তরুর মুখটি দেখতে ইচ্ছে করছিল। আমি ঘুরেফিরে শুধু তরুকেই দেখছিলাম। বেশভূষায় খুবই সিম্পল। ডাগর চোখে লম্বা কাজল টানা। কপালে ছোট্ট কালো টিপ। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। উপরের ঠোঁটের খানিকটা উপরে ছোট্ট কালো তিল উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মায়াবী মুখটায় আলাদা সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। পিছনে লম্বা বেণী দুলছে। ভদ্র, মার্জিত,রুচিশীল স্কুল শিক্ষিকা তরুকে প্রথম দেখেই আমার পছন্দ হয়ে যায়। মিনার রুমে ফিরে তরুর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই।

মিনা বলল,' দেড় মাস হলো তরু আমার স্কুলে জয়েন করেছে। বিয়ে হয় নি। ইংরেজিতে অনার্স পাশ করে মাস্টার্স পরীক্ষা দিল। বেশি কিছু জানি না। বাসায় সম্ভবত বাবা,আর এক ছোটবোন থাকে। মেয়েটার মা নেই। বাবা অবসরে গেছেন এক বছর হলো। মেয়েটার বাবা মনে হয় ব্যাংকার ছিলেন।'

তরু সম্পর্কে মিনার কাছ থেকে জেনে ওর প্রতি মায়া দ্বিগুণ বেড়ে গেল। ছেলেকে বিয়ে করাবো মিনাকে কিছু বলিনি। মিনার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিয়ে বাসায় আসার সাথে সাথে তুবাকে ফোন দিয়ে বললাম,

-তোর দাদাভাইকে বিয়ে করাবো। কি বলিস?

মেয়ে পছন্দ করে আসছি।

তুবা উচ্চস্বরে হেসে বলল,

-বল কী? তোমার হাবলা ছেলের জন্য কোথায় পাত্রী পছন্দ করে আসলে?

-তুই দু'দিনের জন্য জামাইকে সাথে নিয়ে আমার এখানে আয়! সব জানতে পারবি।

-ঠিক আছে মা! তোমাদের জামাইকে নিয়ে কালকে বিকালেই আসছি, ইনশাআল্লাহ।

তুবা,শিবলু আসার পর ঘরোয়া বৈঠকে তরু সম্পর্কে ওদের সব জানালাম। মিনাকে দিয়ে তরুর বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে উনি আমাদের সাথে আত্মীয়তা করতে রাজি হলেন।

মাহিকে তরুর স্কুলের ঠিকানা দিয়ে বললাম,

'এক ফাঁকে মেয়েটার সাথে কথা বলে আসিস।আমার বিশ্বাস তোর পছন্দ হবে।' মাহি হেসে জবাব দিল,'তোমার পছন্দ হয়েছে তো! আমার দেখার দরকার নেই।'

ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই সবকিছুতে আমার উপর খুব ভরসা করে। ছোটবেলা বৃত্তির টাকা

হাতে পাওয়া মাত্রই বাসায় এসে আমার হাতে দিয়ে বলতো,' তুমি রেখে দাও। আমি টাকা দিয়ে কি করবো?' গর্বে,আনন্দে মনটা ভরে যেতো। পরবর্তীতে স্কলারশিপের টাকা দিয়ে ওর নামেই একটা ব্যাংক একাউন্ট করে দেই।

উভয় পরিবারের সম্মতিতে অল্প দিনের মধ্যেই বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তরুকে আমার একমাত্র ছেলের বউ করে ঘরে আনলাম।

আমার সুখের 'আনন্দ ভিলা' স্বামী, ছেলে,বউ

মেয়ে,জামাই সবাইকে নিয়ে এখন পরিপূর্ণ।

তুবা কিছুদিন থেকে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময়

তরু,মাহিকে উদ্দেশ্যে করে বলল,

'শোনো, মা,বাবা হচ্ছে তোমাদের দুটো ছেলে- মেয়ে। এই বুড়ো সন্তান দুটোর যেন কোনো রকম অযত্ন,অবহেলা না হয়, মনে রেখো!'

তরুকে তুবার বাবারও ভীষণ পছন্দ হয়েছে।

মনে মনে সে খুব খুশি। একমাত্র ছেলের বৌ'য়ের হাতে চা খাওয়ার জন্য 'তরু' নামে ডাকতেই তরু মৃদু হেসে চায়ের মগ হাতে সামনে উপস্থিত। তরু এই ক'দিনে বুঝে গেছে তার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর বাবা চা পাগল মানুষ। সন্ধ্যার পর মিনার ফোন পেয়ে অনেক সময় প্রাণখুলে কথা বললাম। মিনা কথায় কথায় বলল,'তরু কী স্কুলের চাকরিটা করবে? আমি বললাম,'আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তরু চাকরি করতে চাইলে করবে। তোর স্কুল ছেড়ে বেটার কোনো জায়গায় সুযোগ পেলে তাও করতে পারবে। মিনা হেসে বলল,'খুশি হলাম বন্ধু! শান্তিও পেলাম। তরু একদিন কোন প্রসঙ্গে বলছিল, তার বেতনের টাকাটা ছোট বোনের লেখাপড়ার পিছনে চলে যায়। দুটো টিউশনিও করতো। মেয়েটা খুবই পরিশ্রমী এবং মেধাবী। মন থেকে মেয়েটাকে খুব পছন্দ করি,

ভালোবাসি। তরুসহ তোদের সবার জন্য দোয়া করি বন্ধু! ভালো থাকিস! বললাম,'তুইও ভালো থাকিস! বন্ধের দিন চলে আসিস। তরুর হাতের রান্না খেয়ে যাবি।'

আজ শুক্রবার। তুবাকে আগের দিন ফোন দিয়ে বললাম,'শ্বশুর,শাশুড়ি,জামাইকে নিয়ে দুপুরে আমার এখানে খাওয়া-দাওয়া করবি।' তুবা বলল,'বাবা মা'কে নিয়ে কক্সবাজার গেছেন।

বাবার বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে। ঐখান থেকে সবাই কক্সবাজার বেড়াতে গেছে।

আমি আর শিবলু জোর করে বাবার সাথে মা'কে পাঠিয়ে দিয়েছি। বাবা মা'কে নিতে চাচ্ছিলো না। মা নাকি আস্তে হাঁটে।' তুবার কথা শুনে হাসলাম।

বললাম,'ভালোই করেছিস! তোর শ্বশুর শাশুড়ি বুড়ো বয়সে হানিমুন করে আসবে। জামাইকে নিয়ে তুই সকাল সকাল চলে আসিস'। 'ঠিক আছে মা,রাখছি।'

সকাল থেকেই রান্না নিয়ে ব্যস্ত। রান্নাটা আমিই করছি।তরু,আর সাহায্যকারী জমিলা সব গুছিয়ে দিচ্ছে। তরু রান্না করতে চাইছিল। আমি দেইনি। তরু বলছিল,সে বিফ বিরিয়ানি খুব সুন্দর রাঁধতে পারে। বললাম,নেক্সট যখন বাসায় মেহমান আসবে। তুমি তোমার পছন্দের রেসিপি রান্না করো। তরু মুচকি হাসলো। কাবাবের প্লেট সামনে রেখে বলল,'মা,আপনি এখন গোসলে যান। কাবাব ভেজে বাকি কাজগুলো জমিলা খালাকে নিয়ে আমি করতে পারবো।' আমি বললাম'কিচেনের সব ঝামেলা শেষ করেই যাই। জুম্মার দিন। ওরা এখনি চলে আসবে।' কড়াই উনুনে চাপিয়ে দিয়ে তরু জিজ্ঞেস করলো,

'মা,তুবা আর শিবলু ভাই ছাড়া আরও কেউ কি আসবে?'

হেসে বললাম,'হুমম,আরও দু'জন আসবে। আমাদের খুব কাছের মানুষ।'

এর মাঝে তুবার গলার আওয়াজ পেলাম। মেয়েটা বাড়িতে পা রাখতেই বাড়ির প্রতিটা

মানুষ,গাছপালা, সবাই জেনে যায় তুবা আসছে। কখনোই নিঃশব্দে মুখ গুমরা করে বাসায় ঢুকে না। এসেই জোরে জোরে বলছে,

'তোমাদের বৌ,শাশুড়ির রান্নার ঘ্রাণ আমি মাঝপথ থেকেই শুঁকে শুঁকে আসছি। এত কি রান্না করো?' ওকে একা দেখে বললাম,'শিবলু কোথায়? রেখে আসছিস?' হিজাবের পিন খুলতে খুলতে বলল,'মসজিদ দেখে তোমার জামাই নেমে গেছে। জামাত শুরু হয়ে গেছে নাকি।'

রান্না শেষ করে চলে গেলাম গোসলে। এদিকে তরুর সাথে তুবাও খাবার টেবিল সাজাতে হাত লাগালো। শিবলু,তুবার বাবা মসজিদ থেকে আসার পর পরই মাহির সাথে তরুর বাবা,বোন চলে আসলো। বাবা,বোনকে দেখে তরুর চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আনন্দে মেয়েটার চোখ দুটো ছলছল করছে। আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। মেয়েটাকে খুশি করতে পেরে নিজের কাছেও খুব ভালো লাগছে।

দেরি না করে আমি সবাইকে নিজ হাতে বেড়ে খাওয়াই। তুবা ওদের সাথে খেতে বসলো না।

বললো,'ভাবী আর তোমাকে নিয়ে একসাথে খেতে বসবো।' ওদের খাওয়া হলে ড্রয়িং রুমে চলে গেল আড্ডা দিতে। গল্পে গল্পে মেয়ে আর বৌ'কে নিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। বিকালে চা খেয়ে তুবা জামাইকে নিয়ে চলে গেল। পরদিন অফিস আছে। তরুর বাবা মাগরিবের নামাজ পড়ে চা খেয়ে ছোট মেয়েকে নিয়ে বিদায় নিলেন। বাবাকে বিদায় দিতে গিয়ে তরুকে দেখলাম চোখ দুটো পানিতে চিকচিক করছে।

জমিলাকে সিংকের এঁটো বাসন ধুতে বলে তরুর রুমে আসলাম। দেখি তরু ঘরে নেই। বারান্দায় আসলাম। তরু গ্রিল ধরে খোলা আকাশের দিকে

তাকিয়ে আছে। বাবা,বোন চলে গেছে। হয়তো মনটা খারাপ হয়ে আছে। আস্তে করে কাঁধে হাত রাখলাম। তরু চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছলো। ওর ডান হাতটা ধরে কাছে টানলাম। জড়োসড়ো হয়ে বুকের কাছে একটু এগিয়ে এসে বলল,'মা,আমি ভাবতেও পারিনি বাবা আর ছোট বোনটাকে আজ এখানে খাবার টেবিলে পাবো। ভালো ভালো খাবার কখনোই বাবা, রেনুকে ছাড়া খেতে পারতাম না। আজ যখন রান্না হচ্ছিল তখনও বাবা,রেনুর মুখটা বারবার চোখে ভাসছিল।' মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে বললাম,'তোমার মা তোমাকে পেটে ধরেছে। উনি তোমার গর্ভধারিণী মা। উনি বেঁচে থাকলে কতবার তুমি উনার বুকে মুখটি গুঁজে দিতে।

কত বায়না ধরতে। আমি তোমাকে পেটে ধরিনি। যেইদিন মিনার স্কুলে প্রথম দেখেছি ঐদিনই তোমায় আমি হৃদয়ে ধারণ করে নিয়েছি।

আমি তোমার 'হৃদেধারিণী মা'। যে কোনো কথা, ইচ্ছে,শখ,বায়না নিঃসংকোচে আমাকে বলবে।

চাকুরি করার ব্যাপারে আমাদের কোনো বিধিনিষেধ নেই। তুমি ইচ্ছে করলে ভালো কিছুর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারো। রেনুর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার জন্য বিয়ের আগে যেভাবে হেল্প করেছো এখনও পারবে।'

আমার কথাগুলো শুনে তরু চুপচাপ। কোনো কথা বলছে না। আমিও আর কিছু বলতে পারছি না। খানিক সময় পর বুঝলাম মেয়েটা কাঁদছে।

আমার চোখ দুটোও কেন জানি স্যাঁতসেঁতে।

 

মাকসুদা খাতুন দোলন

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।