Search

রম্যগল্পঃ ইজিপশিয়ান সিস্টার

  • Share this:

ডিউটিতে আমার সাথে এক ইজিপশিয়ান সিস্টার আছেন। ভদ্রমহিলার বয়স অনুমান করা মুশকিল। তবে খুব বেশি বয়স হবার কথা না। দেখে মনে হচ্ছে তিরিশ থেকে পয়ত্রিশের মধ্যে হবে। টিপিক্যাল মিশরীয় চেহারা।

ডিউটির শুরু থেকে সিস্টার অনর্গল মোবাইলে কার সাথে জানি কথা বলে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর!

অবশ্য রোগী আসার সাথে সাথে মোবাইল কেটে দিয়ে রুগীর প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন। পেশেন্টের ব্যাপারে আবার খুবই কেয়ারিং।

বাচ্চার নাম, নম্বর জিজ্ঞেস করে রেজিষ্ট্রেশন বুকে এন্ট্রি করছেন। বাচ্চার টেম্পারেচার ও ওজন দেখছেন। কোন পরীক্ষা নীরিক্ষার পরামর্শ দিলে সেই ফর্মগুলো ভালোমতো লিখে দিচ্ছেন। বাচ্চার বাবা-মার সাথে হাসিমুখে কথা বলছেন।

কিন্তু রুগী চলে যাবার পর মোবাইলটা হাতে নিয়ে আবার আগের মতো অবস্থা। কুটকুট করে কথা বলা যাচ্ছেন। এতো কথা মানুষ কিভাবে বলে আমার মাথায় আসে না!

মোবাইলের ওই পাশে যিনি আছেন তিনিও সম্ভবত অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছেন। কারণ রিং হবার সাথে সাথেই উনি খপ করে ধরে ফেলছেন।

কথার মাঝখানে সিস্টার লাজুক লাজুক হাসি দিচ্ছেন। সাধারণত মেয়েদের নতুন প্রেম কিংবা বিয়ে হলে এমন হাসি দেয়। কখনও আবার খিলখিল করেও হেসে উঠছেন। হাসলে আবার বাঙালি মেয়েদের মতো গালে হালকা টোল পড়ে।

সিস্টারের কথোপকথনের ভঙ্গি খুব বেশি সুবিধার ঠেকছে না।

মনে হচ্ছে উঠতি বয়সী কোন তরুনী উথাল-পাথাল প্রেমে পড়েছে। এই ধরনের হঠাৎ আসা প্রেমে লাজ শরম কিছুটা কমে যায়। চারপাশে কে কি ভাবছে এইসব অনুভূতি হ্রাস পায়। সিস্টারের মধ্যেও শরমের ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

মানুষ প্রেমে পড়লে ঘন্টার পর ঘন্টা অপ্রয়োজনীয় ফালতু সব কথা বলে। আমার সামনে বসে সিস্টার সেটাই করে যাচ্ছে।

হয়তো 'কি দিয়ে লাঞ্চ করছো' এমন একটা সাধারণ প্রশ্ন করে ঘন্টাখানিক সময় পার করে দিচ্ছে!

সিস্টারের হাবভাব সত্যিই রহস্যময়। নিশ্চিত মোবাইলের ওইপাশে থাকা মানুষটাও সিস্টারের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।

সিস্টার বিবাহিত কিনা এখনো জিজ্ঞেস করিনি। ম্যারিড হলেতো আরও সর্বনাশ! সেক্ষেত্রে এটাকে ঠিক প্রেমও বলা যাবে না। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বলতে হবে! এটা মনে হতেই নিজের অজান্তে জিহবায় কামড় দিলাম। মনে মনে বললাম, ছি ছি ছি..

সিস্টার আরবিতে কথা বলছেন। উনার কোন কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

যদিও আমি সামান্য কিছু আরবি জানি, কিন্তু সিস্টারের কথাবার্তা এমুহূর্তে দুরূহ লাগছে। উনি ইচ্ছে করে কঠিন কঠিন সব আরবি উনাদের আঞ্চলিক ভাষায় বলছেন যাতে কিছু বুঝতে না পারি।

এরমধ্যে অবশ্য সিস্টার আমাকে দুইবার জিজ্ঞেস করেছেন তার এভাবে কথা বলাতে আমার কোন ডিসটার্ব হচ্ছে কিনা। আমি বিরক্ত হলেও কেন জানি না সূচক মাথা নাড়িয়েছিলাম।

যদিও এটা ঠিক হয়নি। আমার বলা উচিত ছিল আপনার ডিসিপ্লিন ঠিক নাই। ডিউটি চলাকালীন সময়ে এতো কথা কিসের?

সিস্টারের ডিউটি শেষ হবে সন্ধা ছয়টায়। শিফটিং ডিউটি। এরপর উনার জায়গায় আর একজন সিস্টার আসবেন।

উনার ডিউটি শেষ হবার আগে কিছুটা সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম,

যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

উনি বললেন, শিওর।

বললাম, তুমি এতো লম্বা সময় ধরে কার সাথে কথা বলছিলে?

সিস্টার বেশ শব্দ করে হেসে উঠলেন। রহস্যময় হাসি।

বললেন, ডক্টর.. আমার ধারণা আজ তুমি ভিতরে ভিতরে নিশ্চয় বিরক্ত হয়েছো। তোমার চেহারা দেখে আমি সেটা টের পেয়েছি।

তবে উল্টাপাল্টা কিছু ভেবো না। আসলে আমি আমার হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলছিলাম। সে এখন কায়রোতে আছে। আগামী সপ্তাহে কুয়েত আসবে ইনশাল্লাহ। দোয়া করো যেন ঠিকঠাক আসতে পারে।

জিজ্ঞেস করলাম, তোমার ছেলেমেয়ে কয়জন?

বললো, দুই ছেলে। তারা যমজ। ওরা দু'জনেই কায়রোতে থাকে। এই বছর এ লেভেল শেষ করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। ওদের বাবা এখন কায়রোতে আছে।

আমি মেডিকেল পড়ুয়া দুই সন্তানের মায়ের দিকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাকিয়ে আছি।

এবার আর সিস্টারকে আগের মতো মনে হচ্ছে না!

এবার মনে হচ্ছে একজন দায়িত্বশীল মা এবং একজন দায়িত্বশীল স্ত্রী আমার সামনে বসে আছেন।

ডিউটি শেষ করে সিস্টার চলে গেলেন। সিস্টারকে ভুল বোঝার জন্য নিজের কাছে খুব খারাপ লাগছে।

এই বয়সে স্বামীর সাথে সিস্টারের কতোই না মিষ্টি মধুর সম্পর্ক! একটানা বিরতিহীন কথা বলে গেছেন। কথা বলার সময় কোন টায়ার্ডনেস চোখে পড়েনি। এই বয়সেও স্বামীর সাথে কথা বলার সময় বারবার লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে পড়ছিলেন! এই ধরনের দৃশ্য পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়।

এই জুটির কাছ থেকে আসলে অনেক কিছু শেখার আছে। তাছাড়া স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রেমালাপ কিংবা হাসিমুখে কথোপকথন.. এটাতো অনেক বড় সওয়াবের কাজ।

হঠাৎ করে আমার স্ত্রীর কথা খুব মনে পড়ছে। মনে হলো আমিও তো এমন করে গল্প করতে পারি। আমিও তো রোমান্টিক হতে পারি!

মোবাইল করলাম।

ওপাশ থেকে আমার প্রিয় স্ত্রীর হালকা মিষ্টি কর্কশ কন্ঠ ভেসে উঠল।

জিজ্ঞেস করলো, কি সমস্যা? তোমার আজ কোন রুগী নাই নাকি?

বললাম, এই মুহুর্তে রুগী নাই।

স্ত্রী বললো, রান্না করছি.. জলদি বলো ফোন দিয়েছো কেন?

এমনি ফোন দিছি.. তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে!

ওপাশ থেকে আর কোন আওয়াজ আসছে না। মোবাইলে শুনশান নীরবতা। আমার স্ত্রী চুপ করে আছে। এমনও হতে পারে আনন্দে তার দুচোখে জল চিকচিক করছে!

এরপর কি কথা বলবো কিছু বুঝতে পারছি না। মাথাটা খালি খালি লাগছে। আমার সামনের ওয়ালে খুব সুন্দর একটা পোস্টার আছে। পোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছি। পোস্টারে দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট কিউট মেয়ে হাসোজ্জল ভঙ্গিতে সূর্যমুখীর বাগানে সূর্যমুখী ফুল ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাধারণত বেশিরভাগ শিশু ডাক্তারদের চেম্বারে এমন সুন্দর সুন্দর কিউট বেবিদের ছবি টাঙানো থাকে।

ছবি দেখে হঠাৎ সূর্যমুখী তেলের কথা মাথায় আসলো।

বললাম, গত সপ্তাহে যে পাঁচ লিটার সানফ্লাওয়ার তেল কিনছিলাম ওটা কি এখনও আছে নাকি শেষ হয়ে গেছে?

বললো, তেল আমি সব ঢকঢক করে খেয়ে ফেলেছি!! এই কথা বলার জন্য আমাকে ফোন দিয়েছো??

তারপর মোবাইলটা কেটে দিল।

আমি মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছি। সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধি করছি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কোথাও আমার কোন ভুল হয়েছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছি।

কিছুক্ষণ আগে বিদায় নেয়া সেই ইজিপশিয়ান সিস্টারের কথা মনে পড়ছে।

সিস্টার এবং সিস্টারের স্বামীর কথা ভেবে খুব অবাক হচ্ছি।

উনারা চার ঘন্টা টানা কথা বলেছেন। সিস্টারের মধ্যে সামান্য কোন ক্লান্তি চোখে পড়েনি।

এরপর দেখা হলে অবশ্যই সিস্টারকে জিজ্ঞেস করবো,

সেদিন কি আপনি আসলেই আপনার স্বামীর সাথে কথা বলছিলেন? যদি সত্যিই তাই হয় তাহলে সেটা কেমনে সম্ভব??

উনাকে এটাও বলবো, আমাদের দেশের দম্পতিরা অনেক সিরিয়াস এবং দায়িত্বশীল। তারা কখনো আপনাদের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা এমন আজাইরা ফালতু প্যাচাল পাড়ে না!

 

## জহির সাদিক

কুয়েত/ ০৫.১০.২১

 

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।