আমিরুল মোমেনীন হযরত আবু বকর (রাঃ) হাবশী বেলাল (রাঃ) এর পথ আগলে দাঁড়ালেন!
-বেলাল আমায় ছেড়ে যেওনা;তোমার বিচ্ছেদ বেদনা আমায় কাতর করবে!
রাহমাতাল্লিল আ'লামীন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন;আমরা এতিম হয়ে গেছি!
তুমিও চলে গেলে আমরা……
-আমিরুল মোমেনীন!আপনি আমায় দাস থেকে আজাদ করেছেন আল্লাহর জন্য না কি আপনার সঙ্গী বানানোর জন্য?
-আল্লাহর জন্য।
-তাহলে দয়া করে আমায় যেতে দিন।
যে মাটিতে আমার রাসুল(সাঃ) নাই,
যে মসজিদের মিম্বরে হুজুর(সাঃ) নাই সেখানে আমি কি করে রই আমিরুল মোমেনীন?
-আমি অত জ্ঞানী নই বেলাল!তোমার মত ভাগ্য নিয়েও আমি জন্মাই নি।মে'রাজ থেকে ফিরে রাসুল(সাঃ)কে প্রায়ই বলতে শুনেছি-'আমি আর বেলাল একসাথে জান্নাতে প্রবেশ করব'!
জান্নাতে রাসুল(সাঃ) স্বয়ং তোমার ঘর দেখে এসেছেন!
আমি হুজুর(সাঃ)এর আবাল্য বন্ধু,
সুখ দুঃখের সঙ্গী ছিলাম।আমি তাঁর শশুর ও বটে;আমি রাহমাতাল্লিল আ'লামীন কর্তৃক সিদ্দিকে আকবর উপাধি প্রাপ্ত!
এত কিছুর দোহাই দিয়ে তোমায় মদিনা ছেড়ে সিরিয়ায় যেতে নিষেধ করছি।
হযরত বেলায় তাঁর পিঠ থেকে ঝোলা ব্যাগ নামিয়ে আবু বকর(রাঃ)এর পায়ের কাছে রেখে দিলেন!ঝোলায় ছিন্ন মলিন কিছু বস্ত্র,পানাহারের জন্য থালা,
একটা মগ,যৎসামান্য যবের আটা।
বেলাল(রাঃ) হাউমাউ করে কাঁদছেন।
-আমিরুল মোমেনীন এ কি মায়ার বাঁধনে জড়ালেন আপনি আমায়!আমি জিহাদের ময়দানে শত্রু বুহ্য ছিন্ন করতে পারি আপনার মায়ার জাল ছিঁড়তে পারিনা,
বড় কষ্ট!বড় কষ্ট!
হযরত বেলাল,ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর(রাঃ)এর খেলাফতের দুই বছরের পুরোটা সময় আর মদিনা ছেড়ে কোথাও যাননি।
তাকে কেউ আযান দিতেও আর দেখেন নি।অথচ তিনি মুয়াজ্জিন-ই- উলা,অর্থাৎ ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন!
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর(রাঃ) এর
খেলাফত চলছে!
হাবশী বেলাল(রাঃ)সিরিয়ায় যাবার অনুমতি প্রার্থনা করলেন!
ওমর(রাঃ)পুর্ববর্তী খলিফার মত বেলালকে মদিনা ছেড়ে যেতে নিষেধ করলেন।
বেলাল(রাঃ)এর মন খারাপ।কি হবে মদিনায় থেকে?মসজিদে নববীতে নামাজ পড়তে গেলে বেলালের বুক ভেঙ্গে হুহু করে কান্না আসে!দয়াল নবীর মিম্বরে নবীজি নাই!
বেলালের মর্ম বেদনা কলিজা ছিঁড়ে কাউকে দেখাতে পারেন না।তিনি পুনঃপুন মদিনা ছেড়ে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করতে লাগলেন!
কোমলে কঠোরে গড়া ওমর(রাঃ) মুয়াজ্জিন-ই-উলা'র মানসিক স্বাস্থ্য বিবেচনায় বেলাল(রাঃ) কে সিরিয়া গমনের অনুমতি দিলেন!শর্ত জুড়ে দিলেন ইসলামী খেলাফতের প্রয়োজনে সংবাদ পাওয়া মাত্রই পত্রপাঠ মদিনায় চলে আসবেন!
হযরত বেলাল মদিনা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
মদিনার আনসারী,মোহাজের মুসলিম নর নারী,শিশু,বৃদ্ধ চোখের জলে বেলাল(রাঃ) কে বিদায় জানান।
সিরিয়ায় বেলালের মন আস্তে আস্তে থিতু হতে থাকে।তবু কেবলই মনে হয় কি যেন কি নেই।তিনি রাত জেগে ইবাদত করেন।
ইদানিং রাতে খুব একটা ঘুম হয়না তাঁর!
ছয়মাস হয়ে গেছে তিনি সিরিয়ায় এসেছেন…দ্বীনের খেদমতই করছেন,তবু কি এক শূণ্যতা তাকে ভর করে,ক্রমশ গ্রাস করে।
আজ তাহাজ্জুদের পরপরই বেলাল(রাঃ) এর চোখ ভেঙ্গে ঘুম নেমে আসে-রাজ্যের ঘুম!তিনি স্বপ্নে দেখেন সবুজ পাগড়ি পরে রাসুল(সাঃ) তার শিয়রে এসে বসলেন।
বেলালের শিয়রে এখন মেশকে আম্বরের ঘ্রান!তিনি এ ঘ্রানের সাথে পরিচিত!
-বেলাল!
-ইয়া হাবিব আল্লাহ!
-আমাকে এভাবে ভুলে গেলে?
কতদিন তোমার সাক্ষাৎ পাইনা!
না মসজিদে নববীতে,না আমার রওজার পাশে!
বেলাল(রাঃ) ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে কেঁদে উঠেন!
-ইয়া রাসুলুল্লাহ!আমি আসছি!আমি আসছি!
সিরিয়া থেকে উটে একমাসের পথ পাড়ি দিয়ে বেলাল(রাঃ) মদিনায় রওজাতুন্নবীতে এসে উপস্থিত!
দীর্ঘ পথশ্রমের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি!দিনে প্রখর রোদ,রাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় পথ চলার কষ্ট সবই তিনি ভুলে গেলেন এক নিমিষেই।
তিনি হিতাহিত জ্ঞানশূন্য এখন।
রাসুল(সাঃ)এর রওজা ধরে কেঁদে কেঁদে সালাম দিচ্ছেন বেলাল-ইয়া নবী সালাম আলাইকা,ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা!
তিনি রওজার পাশে লুটিয়ে পড়লেন,জবেহ করা কবুতরের মত ছটফট করছেন বেলাল।
দলে দলে মদিনার সাহাবী,আনসারী ও মোহাজের নারী পুরুষ বেলালের মদিনায় আগমনকে স্বাগত জানিয়ে গাইছে আহলান সাহলান ইয়া বেলাল!আহলান সাহলান ইয়া বেলাল!
মদিনার ঘরে ঘরে আজ আনন্দ!আবার মসজিদে নববীতে আজান হবে…সেই বেলালী আজান!
সবাই বেলাল(রাঃ) কে আজান দেয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেন।বেলাল কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না!
ভীড়ের মধ্যে কেউ একজন বলে উঠলেন-
-হাসান(রাঃ) হোসাইন(রাঃ) কে ডেকে আনা হোক!বেলাল রাসুল দৌহিত্রের কথা ফেলতে পারবেন না।
উপস্থিত সবাই এ কথার সমর্থনে হাসান হোসাইনকে ডেকে আনলেন।
তখন সুবহে সাদিকের সময়!
হাসান হোসাইনকে তিনি কোলে তুলে নিলেন!
হোসাইন(রাঃ)বেলাল (রাঃ)কে ফজরের আজান দিতে অনুরোধ করলেন!
এবার বেলাল না করলেন না।
বেলাল(রাঃ)দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়ালেন!
ঋজু ভঙ্গিতে হেঁটে হেঁটে মসজিদে নববীর ছাদের দিকে যাচ্ছেন-একবারও পিছন ফিরে তাকালেন না!পিছনে অগণিত আশেকে রাসুল,হাসান,হোসাইন দাঁড়িয়ে!
মসজিদে নববীর ছাদে উঠেই তিনি সেই বেলালী কন্ঠে আজান শুরু করলেন……
-আল্লাহু আকবর,আল্লাহু আকবর!
আশহাদু আ'ল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ!
মদিনার সমস্ত মুসলিম নারী পুরুষ মসজিদে নববীর দিকে দৌঁড়ে ছুটে আসতে লাগল,বাচ্চারা হর্ষধ্বনি দিয়ে পথে নেমে এলো…আজানের পরেই হয়ত রাসুল(সাঃ)এর ইমামতিতে নামাজ হবে!
কিন্তু না রাসুল(সাঃ)আর মসজিদে নববীতে নামাজ পড়াতে আসবেন না!
হযরত বেলালের কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসছে!বুক ক্রমাগত ফুলে ফুলে উঠছে…তার চোখ খেজুর পাতার ছাউনি ভেদ করে মিম্বরে রাসুল(সাঃ) খুঁজছে…
বেলাল(রাঃ) আজান দিচ্ছেন-আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ……আজান সমাপ্ত করতে পারলেন না-তিনি মসজিদে নববীর অনুচ্চ ছাদ থেকে জ্ঞান হারিয়ে ভুমিতে পড়ে গেলেন!
সবাই ধরাধরি করে তাকে সুস্থ করলেন!
বেলাল শুধু বললেন-আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ এই বাক্যটাতে এসে আমার জবান বন্ধ হয়ে যায়,কন্ঠরুদ্ধ হয়ে যায়!
আমায় ক্ষমা করুন হে আশেকে রাসুল বৃন্দ,হে আমার পেয়ারা আহলে বাইত আমায় ক্ষমা করুন!
উপস্থিত সাহাবীরা বলতে লাগলেন আশেকে রাসুল কারে বলে দেখুন,শিখুন,হৃদয়াঙ্গম করুন!
মহান আল্লাহও চান তাঁর বান্দারা এভাবেই রাসুল(সাঃ)কে মহব্বত করুক,ভালোবাসুক!
পাক কোরানে তাই রাব্বুল আ'লামীন এ কথার সমর্থনে আয়াত নাযিল করেন-'ইন কুন্তুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবি'উনি ইহবিব ক্বুমুল্লাহ,ওয়া ইয়াগফির লাক্বুম যুনুবাক্বুম ওয়াল্লাহু গাফুরুর রাহীম'!
এই ঘটনার পর বেলাল(রাঃ) আর বেশিদিন বাঁচেন নাই!হিজরি বিশ সনে তিনি এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে মহামুনীবের দরবারে পাড়ি জমান… 'ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন'!
সাইফুল আলম
Comments (0)