রাইসা ভ্রু কুঁচকে ফোনের রিসিভারটা আরো জোরে কানে চেপে ধরল। ওর রিএকশনটা কি হওয়া উচিত ও বুঝতে পারছে না। সকালে বাবার কথাগুলো মনে পড়ছে।
: ছেলের সবুজবাগে একটা বাড়ি আছে, ছেলে এডভোকেট……..উচ্চতা পাঁচ ফিট ছয়…….ভাল কামাই করে…তোকে সুখে রাখবে।
ও একবার বাবার মুখের উপর বলতে চেয়েছিল, বাড়ি…কামাই…..উচ্চতা এসব কি ছেলের যোগ্যতা কিনা রাইসাকে বিয়ে করার জন্য। বলতে গিয়েও বলেনি ও। বাবার এখন বয়েস হয়েছে। বেচারা মেয়ের চিন্তায় অস্থির। বারবার একই কথা বলে যান…আহারে...আমি দুচোখ বোজার আগে যদি রাইসার একটা গতি করে যেতে পারি! এখনো হল না। রাইসার বয়স এখন বত্রিশ চলছে। এ সমাজে বত্রিশ বছরের আইবুড়ো মেয়ে এখন অচল পয়সা। রাইসা দেখতে শুনতে মন্দ না। উচ্চতা ছেলেরা চায়। তাও আছে রাইসার। পাঁচ ফুট পাঁচ। কম কোথায়! উজ্জ্বল শ্যামা…ডাগর ডাগর চোখ….ফুলের পাঁপড়ির মতন ঠোঁট। সবাই প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে। তবে আল্লাহ মালুম কেন বিয়ে হয়নি। অবশ্য দোষ এখানে রাইসারই ষোল আনা। রাইসা পড়াশুনা শেষ করতে চাইল। বাবা আপত্তি করেননি। রাইসা চাকরীতে ঢুকতে চাইল, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইল। রাকিব সাহেব তাতেও আপত্তি করেননি। কিন্তু এতেই কাল হয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়ানো মেয়েদেরকে লোকে বিয়ে করতে ভয় পায়। আর বয়েসের হিসেবতো আছেই। লোকে নিজের বয়েস চল্লিশ হলেও বিশ বছরের কঁচি লাউয়ের ডগা চায়। লোকের আর দোষ কি! কঁচি লাউয়ের ডগারাই তরতরিয়ে চল্লিশ বছরের বুড়োর গলায় মালা দিচ্ছে। সেদিন রাইসা কি এক গ্রুপের কথা বান্ধবী বলায় সেখানে এড হয়েছিল। জয়েন হবার পর চক্ষু চড়কগাছ। পাত্রী চাই এক বিজ্ঞাপনটা পড়ে কমেন্ট দেখে মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। ছেলের বয়েস বিয়াল্বিলশ। আঠারো বছরের মেয়ের জন্যও ইনবক্স করছে। কমেন্টে বলে দিচ্ছে মেয়ে ইন্টার পড়ে। রাইসার আর সাহস হল না। গ্রুপটা থেকে লিভ নিয়ে নিল। আজ সকালে বাবা যে ছেলের বর্ণনা দিল সেটাও এক ঘটকের মাধ্যমেই এসেছে। ওর একটিু রাগই লাগল বাবার কীর্তিকলাপে। বাবা অলরেডি ছেলের সাথে একপত্তনি কথা বলেও সেরেছে। আর কথা বলেই বাবার পছন্দ হয়ে গেছে। খোঁজ নেবার আর তার প্রয়োজন নেই। পারলে আজই বিয়েটাও দিয়ে ফেলেন। বাবা ছেলেকে রাইসার ফোন নাম্বারটাও দিয়ে ফেলেছে। ছেলের নাম এডভোকেট রাসেল স্বপন। ছেলেটা এবার রাইসাকে দেখতে চাচ্ছে সরাসরি। রাইসার এত আপত্তি থাকার কথাও নয়। ছেলে বিয়ে করবে মেয়েকে না দেখে হুট করে বিয়ে করে ফেলবে এটা ভাবা অন্যায়।
রাইসা অফিসে কাজ করছিল। কালকের মধ্যে একাউন্টস জমা দিতে হবে। এসি ছাড়া। ফ্যান ঘুরছে মাথার উপর। তবু রাইসার গরম লাগছে। মরিয়ম একটু আগে ঠান্ডা ফ্রিজের পানিতে লেমোনেড বানিয়ে খাইয়ে দিয়ে গেল। গরম ওর মাথার ভেতরে তাঁতিয়ে উঠেছে। হিজাবের ভেতরে চুলের গোড়া ঘেমে উঠছে। ও একবার বেসিনে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে এল। ওর মোবাইলে প্রায় চারবার একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এল। ইগনোর করছে ও। ইদানিং আননোন নাম্বারগুলোকে ইগনোর করে ও। মাজেদ ওর টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল এক কাপ চা নিয়ে।
: চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? রেখে যাও।
: আপা আপনার ফোন আইছে।
: কই?
: ল্যান্ডফোনে।
রাইসা এবার বড় বড় চোখ করে দেখল একবার মাজেদকে। আপার এমন চাহুনি দেখে মাজেদ একটু চুপসে গেল।
: কইছে আর্জেন্ট। আপনারে এক্ষুনি ডাইকা দিতে।
: কে?
: এডভোকেট রাসেল স্বপন।
শুনেই ওর মেজাজ বিগড়ে গেল। ছবি দেখেই লোকটাকে ওর পছন্দ হয়নি। বাবার ভাল ভাল শুনতে শুনতে ওর কান আরো পঁচেছে। আর লোকটার কি তর সয় না? আজকেই ফোন করে ফেলেছে? আর ফোন করে বলে, আর্জেন্ট। লোকটার সংগে কি এমন আর্জেন্ট কাজ রাইসার?
একরাশ বিরক্তি নিয়ে রাইসা ফ্রন্টডেস্কে এসে ফোনের রিসিভার কানে লাগালো।
: হ্যালো। আসসালামুআলাইকুম।
: রাইসা বলছেন?
: জ্বি।
: আমাকে চিনতে পারছেন? আমি আপনার ফোনে অনেকবার ফোন করেছি। রিসিভ করেননি কেন?
রাইসার বিরক্তি লাগছে। ও চুপ করে রইল। লোকটাই উত্তর করল।
: আমি এডভোকেট রাসেল স্বপন।
: জ্বি।
: আপনার সংগে আমার একবার মিট হওয়াটা জরুরী।
: জ্বি।
: আপনার অফিস কোথায়?
: ধানমন্ডি।
: গুড। আমি কাল দেখা করব। আপনার নোটবুক আছেনা?
রাইসা খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেল। লোকটার সংগে দেখা করবার জন্য নোটবুকের কি দরকার?
: নোটবুকটা খুলুন।
রাইসা কোন উত্তর না দিয়ে দাঁত কামড়ে কষ্টে চুপ করে রইল।
: কলম নিয়েছেন? এবার লিখুন। কাল বিকেল পাঁচটা। বসুন্ধরা ফুড কোর্ট। লিখেছেন? বাই। কালকে বিকেল পাঁচটায় ফুড কোর্টে দেখা হচ্ছে।
ওপাশের লোকটা ফেনের রিসিভারটা খট করে রেখে দিয়েছে। শব্দ হল। রাইসা হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। রিসেপসনিস্ট মেয়েটা রাইসার দিকে তাকিয়ে রইল।
: কিছু হইছে আপা?
উত্তরে কি বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না ও। মাথার ভেতর থেকে মনে হচ্ছে গরম ভাঁপ বের হচ্ছে।
ফিরে নিজের ডেস্কে বসে বোতল খুলে ঢকঢক করে প্রায় এক লিটার পানি খেল ও। তারপর বাবাকে ফোন দিল।
: তুমি কার সাথে আমাকে দেখা করতে বলেছ?
: কেন? কি হয়েছে?
: তার সংগে আমি দেখা করব সেটা আমাকে কেন নোটবুওেক লিখে রাখতে হবে?
: অনেক কাজ করেতো। আর ছেলেটা সিস্টেমেটিক। ভালতো।
: আর একবারও জিগেস করেছে আমার কোন জায়গায় যেতে সুবিধা! হুট করে নিজের মত আমার উপর চাপিয়ে দিল! আমার মতের কোন গুরুত্বই নাই! আমাকে একবার জিগেস করার প্রয়োজন বোধ করল না! আদেশ দিয়ে গেল!
: আরে কিছুকিছু মানুষের ব্যবহার এমনই হয়। সব মানুষতো সমান না। মানিয়ে নিতে হয়।
: আমি এ ব্যাটার সাথে দেখা করব না।
: এমন করিস না মা….দেখা করে আয়। তুই একা না রাফিদকেও তোর সংগে পাঠাচ্ছি। তোরা দুই ভাইবোন একবার যা। আর বলবোনা মা। ছেলেটা অনেক ভাল।
রাইসা ফোন রেখে চুপচাপ বসে রইল। ওর কেমন যেন অপমান অপমান লাগছে। যে লোক দেখা হবার আগে এমন আদেশ দেয়, সে বিয়ের পর জীবনকে তেজপাতা বানাবে, কোন সন্দেহ নেই।
পরদিন রাইসা অফিসের কাজ তিনটাতে গুটিয়ে রাফিদকে সংগে নিয়ে চারটাতেই বেরিয়ে পড়ল। রাফিদকে কালকের ঘটনা বলতেই ও খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল।
: মানুষের একেকজনের কথা বলার স্টাইল একেকরকম। তুমি লোকটাকে না দেখে তার সংগে সামনাসামনি না দেখে বিচার করতে পার না।
রাইসা মুখ ঝামটে উঠল।
: তোরা ছেলেরা আরেক ছেলের দোষ বললেও মানতে চাস না।
রাফিদ আর কথা বাড়ায় না।
ওরা ফুডকোর্টে গিয়ে প্রায় একঘন্টা বসে রইল। এডভোকেট সাহেবের পাত্তা নেই। রাফিদ ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছে। এডভোকেট সাহেব এলেন সাড়ে ছয়টার সময়। এসেই মুখটা গম্ভীর করে বসে গেলেন। একবার দেরী হবার জন্য দুঃখ পর্যন্ত প্রকাশ করলেন না। এই গরমে লোকটা কোট-প্যান্ট-টাই পড়েছে বলে রাইসার কেমন যেন হাসি পাচ্ছে। ও অনেক কষ্টে হাসি চাপল।
হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে এডভোকেট সাহেব কথা বললেন।
: খাবার অর্ডার করি। কি বলেন?
রাইসারা চুপ করে রইল।
উঠে গিয়ে নিজেই খাবার অর্ডার করলেন। একবার রাইসাদের জিগেসও করলেন না, আপনারা কি খাবেন! ওরা চুপ করে বসে রইল। খাবারের প্লেট এল। দুইটা। সাসলিক। রাইসা রাফিদ দুজনেই একটু অবাক হল। ভাবল, আরেক প্লেট মনে হয় আসছে। রাফিদ উশখুশ করতে লাগল।
: আরেকটা প্লেট।
: আসছে।
রাইসা এবার চোখ বড় করে দেখল আরেকটা খালি প্লেট এসেছে। লোকটা দুটো প্লেট থেকে সাসলিক ভাগ করে খালি প্লেটে রেখে রাফিদের দিকে বাড়িয়ে দিল।
; আমি দুটাই অর্ডার করেছি। শেয়ারে তিনজন খেয়ে নিব।
রাইসা কোন কথা বলল না। একবার রাফিদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল ওর মনোভাব কি!
বাসায় ফেরার পর বাবা ধরলেন, পছন্দ হয়েছেতো ছেলে? আমি জানতাম পছন্দ হবে। এমন হীরের টুকরো ছেলে পেয়েছি।
রাইসা একবার বাবার দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করল। রাফিদই বাবাকে বলল সব। বাবা তবু হারতে নারাজ।
: ছেলেটা হয়ত মিতব্যয়ী…….।
বাবার আনন্দঘন মুখটা চিমসে গেল। বুঝতেই পেরেছেন এবারেরটাও মেয়ে রিজেক্ট করেছে।
-অহনা কিঙ্বতী
Comments (0)