একমুঠো স্বপ্ন হাতে নিয়ে বসে আছি। হৃদস্পন্দনের গতিটা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি। ক্লান্তিগুলো ঘর্মাকারে কপালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে মাটিতে পড়ছে। হয়ত একেই বলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা।
হাতের মুঠোয় দুমড়ে মুচড়ে থাকা স্বপ্নগুলোর একসময় খুব যত্ন নিতাম। মনের অন্ধকার আকাশে ঝলমল করে জ্বলত স্বপ্নগুলো। আলোকিত করে তুলত অন্ধকারাচ্ছন্ন কালো আকাশটাকে। সময় পেলেই চোখ দুটো বুজে মনের আকাশে সেই তারারূপী স্বপ্নগুলোর ঝলমলানো দেখতাম। কি অদ্ভুত দৃষ্টিকাড়া এক দৃশ্য। এক অদ্ভুত মোহে, এক অদ্ভুত আবেশে জড়িয়ে যেতাম তখন। ঘন্টার পর ঘন্টা ডুবে থাকতাম সেই মোহে। জড়িয়ে থাকতাম সেই আবেশে। এ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি। এক অদ্ভুত ভালোলাগা।
এই অদ্ভুত অনুভূতি ও ভালো লাগা গুলো অতীত হয়েছে বহুদিন হলো। স্বপ্নের মোহ থেকে বেরিয়ে বাস্তবতাকে বুঝতে শিখেছি। হয়ত আরো আগেই বোঝা উচিত ছিল।সেই ভুলের আগে।
এক মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান ছিলাম আমি। পরিবারে আহামরি স্বচ্ছলতা না থাকলেও অভাব ছিলনা।বাবার দিনরাতের পরিশ্রমের আয়ে মোটামুটিভাবে চলে যেত সংসারটা।শত টানাপোড়নের মাঝেও আমার পড়ালেখা নিয়ে কোন আপোষ করতেননা বাবা।আমার তারারূপী স্বপগুলো ঝলমলানোর মূল কারন ছিলেন তিনি।
মধ্যবিত্তদের মনে নাকি তাদের সন্তানদের নিয়ে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন থাকে। আমার বাবারও ছিল। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন।
বাবার সাথে স্বপ্ন দেখতাম আমিও। অনেক বড় পর্যায়ে যাব জীবনে। আগে পিছে হাজার মানুষ ঘুরবে। কোন কিছুর অভাব থাকবেনা। ছেলেকে দেখে গর্বে ফুলে উঠবে বাবার বুকটা। মুখ ফুটে বলবে 'আমার পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে'।
একটা বড় বাড়ি হবে। বাবা-মা আর আমি একসাথে থাকব সেখানে। ছুটির দিনগুলোতে তিনজন একসাথে গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াব। পরিশ্রমের এক স্বার্থক ফল দিব বাবাকে। জীবনের শেষ সময়গুলোতে নাতি-নাত্নীর সাথে হেসে খেলে কাটাবে তারা।
কথাগুলো শুনে হয়ত কারো হাসি আসতে পারে। কিন্তু একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলের স্বপ্নগুলো আর কেমনি বা হবে। ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো ছিলাম। তাই শিক্ষকগণ বলতেন জীবনে একদিন অনেক বড় হব আমি। তাদের এই কথা আমার স্বপ্নের প্রদীপে তেলের জোগান দিত।
তবে নিয়তি হয়ত অন্যকিছুই চেয়েছিল।
স্কুল থেকে পদোন্নতি হয়ে কলেজে উঠার পর নতুন স্বপ্ন নতুন উদ্দীপনা নিয়ে শুরু করি কলেজ লাইফ।শিক্ষাজীবনে কলেজ লাইফ নাকি সব থেকে রঙ্গিন হয়।আমিও মেতে উঠি আমার কলেজ লাইফ রঙ্গিন করতে। প্রথম দিনেই বন্ধুত্ব হয় লিখন আর রনির সাথে।একসাথে বিশাল ক্লাসরুমের পিছনের বেঞ্চে বসে গল্প করেই পার করে দেই প্রথম দিন।কলেজে নতুন থেকে পুরনো হতে হতে আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সাথে ফুর্তি আর বিলাশিতায় মেতে উঠি।
টাকা থাকলে বন্ধুর অভাব হয়না। আমার কাছে টাকা ছিল। বাবার রক্ত পানি করা টাকা। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে আমার ভবিষ্যৎ সুন্দর করতে জমানো টাকা। বলা হয় ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা দিতে নেই। অন্যথায় ছেলেমেয়ে ভুল পথে চলে যায়। কিন্তু তবুও অনেক বাবা মা স্নেহের নামে অতিরিক্ত টাকা তুলে দেয় ছেলেমেয়েদের হাতে। আমার বাবাও দিয়েছিলেন। ফলাফল স্বরূপ কিছু বখে যাওয়া বন্ধুর কল্যাণে আমি নেশার জগতে পা বাড়াই। ভুলে যাই আমি কোথা থেকে উঠে এসেছি। আমার মূল কি। আর কার ঘাম ঝরানো টাকায় আমি বিলাশিতা করছি।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রনি আর লিখনের সাথে চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়াটা নিত্যদিনের মামুলি ব্যপার হয়ে উঠে। দশম শ্রেণীর ফার্স্টবয় কলেজের ১ম সাময়িক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। কলেজে প্রথম দিকে এমনি হয় বলে বাবাকে বুঝ দিয়েছিলাম। বুঝতে একটু টাইম লাগে। বাবার মুখের উপর বলেছিলাম তোমরা তো আর এত পড়ালেখা করনি তাই কিছুই জানোনা। মুখে একটা চাপা হাসি দিয়ে আমার কথায় পাওয়া আঘাতটাকে লুকাতে চেষ্টা করেন বাবা। সফলও হোন। কিন্তু আমার মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনা।
আবার শুরু করি ক্লাস ফাঁকি, আড্ডা আর বিলাশিতা।
একদিন চায়ের দোকানে আড্ডার এক ফাঁকে লিখন আমার হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে নেয় টান দেয়। আমি প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেও লিখন আর রনির জোরাজোরিতে অবশেষে সিগারেটটা হাতে নিয়ে একটি সুখটান দেই। কাশতে কাশতে একাকার হয়ে যাই তখন। তারপর ধীরে ধীরে এক্সপার্ট বনে যাই এতে।
কারো মাধ্যমে বাবার কানে যায় বিষয়টা। আমাকে জিজ্ঞেস করতেই গলা উঁচিয়ে বলেছিলাম বন্ধুদের সাথে একটু আধটু খেতে হয়। এগুলো আধুনিকতা। তুমি মুর্খ মানুষ অত বুঝবেনা। বাবার কাছে আর কোন ভাষা ছিলনা আমাকে কিছু বলার জন্য। নিজেকে জয়ী হতে দেখে মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছিলাম সেদিন।
এর কিছুদিন পরেই চায়েরদোকানে আড্ডার সময় লিখন বলল
- আজ রাতে একটা জায়গায় যাব। চলে আসিস।
কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করতে সে বলল
- আসলেই দেখতে পারবি।
বাবাকে এসাইনমেন্ট এর কথা বলে রাতে বেরিয়ে যাই। লিখন আর রনির সাথে যাই নেশার সবচেয়ে বড় আসর নাইট ক্লাবে। প্রথম সেদিন ড্রিংক করি। মেয়েদের সাথে ফুর্তি করি। সব খরচ লিখনই দিয়েছিল। নেশা করে লিখনের মেসে গিয়ে রাতটা পার করি।
পরেরদিন লিখন বলল আজ রাতে আবার যাবে নাইট ক্লাবে। আর আজকের খরচটা দিতে হবে আমাকে। নাইটক্লাবের খরচ দেয়ার মত কোন টাকাই ছিলনা আমার কাছে। বাবার কাছে চেয়েও এত টাকা পাওয়া যাবেনা। এদিকে যেহেতু গতকাল লিখনের টাকায় ফুর্তি করেছি তাই তাকেও না করতে পারছিলামনা। অবশেষে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্তটা নেই।
নাইটক্লাবের টাকার জোগান দিতে গোপনে পাশের ফ্ল্যাটে ঢুকি। আলমারী খুলে টাকা বের করতেই পেছন থেকে খপ করে এসে ধরে ফেলেন ফ্ল্যাটের মালিক। পুরো বিল্ডিংয়ের মানুষ জমা করে অপদস্থ করা হয় বাবাকে। এত কষ্ট আর পরিশ্রম করে ছেলেকে মানুষ করার এমন প্রতিদান বাবা সইতে পারেননি। বাসায় গিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দেন তিনি। পরবর্তীতে সেই দরজা ভেংগে বের করা হয় বাবার লাশ।
মাও কথা বলে বন্ধ করে দেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী বাবার অনুপস্থিতিতে সংসারের হাল ধরতে হয় আমাকে। পাড়ি জমাই ভিনদেশে। হাজার স্বপ্ন চোখে আর বিলাশিতায় দিন কাটনো আমি এখন গাধার মত খেটে যাই। আর উপলব্ধি করি বাবা কতটা কষ্ট করেছিলেন আমাকে অমন একটি জীবন দেয়ার জন্য।
সাইরেন বেজে উঠেছে। কাজে ফিরতে হবে। হাতের মুঠোয় দুমড়ে মুচড়ে থাকা স্বপ্নগুলো পকেটে পুরে রাখি। থাকনা এগুলো। অবসরে স্মৃতিগুলো আউড়িয়ে দেখব। চোখের কোটর থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসবে। ক্লান্তি মাখা ঘাম আর আবেগ নিংড়ানো কষ্ট মিলেমিশে একাকার হবে। মনের অন্ধকার আকাশটায় মেঘ গর্জাবে। বিদ্যুৎ চমকাবে। ক্ষণিকের জন্য ঝলমলিয়ে উঠবে আকাশটা। তারপর আবার নিভে যাবে। আমি মুচকি হেসে বলব সবই নিয়তির খেল।
নাঈমুর রহমান নাহিদ
Comments (0)