রামনগর ৮ নং রাস্তার মাঝামাঝি কোনো একটা বাড়ি থেকেই সুর শোনা যাচ্ছে ।বহুলোক আসা যাওয়া করছে এই রাস্তা দিয়ে। বিয়ে বাড়ি থেকে? না, শ্রাদ্ধ বাড়ি থেকে? ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, যাই হোক না কেন, লোকগুলো যে কোনো অনুষ্ঠান থেকে আসছে এটা নিঃসন্দেহে অনুমান করে নিল ভিখিরিটা। কাছাকাছি তো কোনো সিনেমা হলও নেই, তবে নিশ্চয়ই ভোজ সভা!ভোজ সভা মানেই তো সরু চালের ভাত মাছ, মাংস, ঘন্টা, ডাল, বেগুনী, দই,মিষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদি। জিভে জল আসছিল ভিখিরিটার। ওসব খাবার তো আর রোজ রোজ জুটেনা। এমনিতেই খাবার জুটেনা, তো আবার এসব খাবার। নাকে গন্ধ পাচ্ছিল ভিখিরিটা। দ্রুত পা ফেলে উত্তম পোশাক পরিহিত লোকেদের পিছু ধরে সোজা পৌঁছে গেলো বাড়িটার সামনে।
কিন্তু ঢুকতে পারলনা, শুধু ও নয়, আরও অনেক ভিখিরি দীর্ঘ প্রতীক্ষায় বসে আছে গেটের বাইরে। নিমণ্ত্রিতরা সসম্মানে চলে যাচ্ছে ভিতরে। বাইরে থেকে দেখে নিল ভিখিরিটা বাড়ির ভেতরে টাঙ্গানো মস্ত শামিয়ানার নিচে ঠাকুর মন্ত্র পাঠ করছে। বুঝতে কষ্ট হয়নি ওর এটা শ্রাদ্ধ বাসর। বিয়ে হলে তো আর দিনে হতো না। সুতরাং, যেমন করেই হোক একটা ব্যবস্থা করে এবেলাটা সারতেই হবে। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে মাটির হাঁড়িও রয়েছে। ওতে কিছু ভাত নিলে দুবার খেতে পারবে। কিন্তু বাড়িটাতে বড্ড ভীর। দেরী হচ্ছে। ভিখিরিটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। একটু ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয়না। সঙ্গে বড় গাঁটরিতে মাথা রেখে রাস্তার ধারেই পড়ে রইল।কিন্তু ঘুমোলেইতো হবে না। কখন ভোজ শেষ হয়ে যায় কে জানে। কিন্তু ঘুমটা বড্ড চেপে আসে। ঘুমিয়ে যায় ভিখিরিটা।
হঠাৎ ধরফরিয়ে উঠে ঘুম থেকে। বাপরে! কি ঘুমই না দিয়েছিল তে মাথার মোড়ে। শ্রাদ্ধ বাড়িতে অতিথি বেশী একটা নেই। যারা আছে বোধ হয় আত্মীয় স্বজন। খিদেয় আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার যোগার। তবুও জোর করে হলেও চেয়ে নেবে ও। হঠাৎ করেই দৃষ্টি পড়ল তার বাঁ দিকে কলাপাতায় সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে ভাত, মাছ, ডিম, ঘন্ট, কাঁচা লঙ্কা। বাঃ, বোধ হয় ওর জন্যেই রেখে গেছে। হঠাৎ মনে হলো এগুলো তো ডালি। কিন্তু পেটে যে ভীষণ ক্ষুধা। হোক্ না ডালি, ওসব খাবার জিনিসইতো। দেরী করল না সে। দৌড়ে গেল খাবারের দিকে। বাপ্ রে! কি বিদিকিচ্ছিরি নজর কাকগুলোর। একটা ডিমে কখন জানি ঠোক্কর মেরে গেছে। মারুক না। ঠোক্কর মারা স্থানটা ফেলে দিলেই তো ঝামেলা শেষ। কাকগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে। গাছের উপরের ডালে বসে ' কাউয়া', ' কাউয়া ' করছে। করুক হতভাগা গুলো। দুতিনটে লোক তাকিয়ে আছে ওর দিকে, তাকাক, এতে ওর কি এসে যায়!
ভিখিরিটা গোগ্রাসে গিলছে সব। হঠাৎ শুনতে পেলো দুজন লোক বলাবলি করছে :এই লোকটাই আজ থেকে পনেরো বছ। ধীর আগে ওর বাপকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ আজ ভক্তির কি ঢেউ!আরেকজন বলল, তো ওর বাপ মরেছে?
--কে জানে অত বছর বেঁচে রয়েছে কিনা। এখন যজমানদের পরামর্শ নিয়ে শ্রাদ্ধ সেরে নিচ্ছে। ভিখিরিটার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো ।ধীরে ধীরে মনে হল এইটাই ওর গ্রাম। এই গ্রামেই তার বাড়ি। কিন্তু স্থানটায় ছিল তা মনে নেই। আজ সব মানুষই তার অপরিচিত। ছেলের নাম মনে আছে, থাকবেই তো, শত হলেও ছেলে তো। ওর নিজের নাম গণেশ রায়। ছেলের নাম নিত্যানন্দ রায়। নাতিটার নামও মনে আছে, গৌরাঙ্গ রায়। টস্ টস্ করে চোখের জল পড়লো। ঝোলাটা কাঁধে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢোকার জো নেই। ভেতর থেকে দেখা যাচ্ছে একজন পঞ্চাশোর্ধ মুন্ডিত মস্তক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে দুচোখের জল ছাড়ছে। আহা! কার পুত্র কে জানে। কত ভাগ্যবান সেই পিতা। ভিখিরিটা একদৃষ্টে চেয়ে আছে বাড়িটার দিকে। গেটের সামনে দাঁড়ানো পরিচারিকা বারবার ধমকাচ্ছে, অ্যাই এই খানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভাগো। সব ভিখিরিকেই খাবার দেওয়া হয়েছে, আর হবে না। যাও যাও।
ভিখিরিটা কাতর ভাবে জানতে চাইলো, দিদি, নিত্যানন্দ রায়ের বাড়িটা কোন দিকে বলতে পারেন?
পরিচারিকা কথা শুনেনি। দড়াম করে গেট বন্ধ করে দিলো। গেটের উপরেই লেখা নেমপ্লেট পড়তে পারেনি ভিখিরিটা।
বিধু রঞ্জন দে
২৭/০৫/২০২১ ইং
Comments (0)