Search

অনুগল্পঃ লাল মলাটের ডায়েরি

  • Share this:

বয়স কত হবে তখন আমার, বড়জোর আঠারো কি উনিশ! উচ্চমাধ্যমিকের শেষ ব্যবহারিক পরীক্ষাটা দিয়ে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরলাম। তখনো কি জানতাম যে আর কয়েক মুহূর্ত বাদেই আমার জীবনটা একদম পাল্টে যাবে।

ড্রয়িংরুমে একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে বসে থাকতে দেখলাম বাবার সাথে। বাবা আমাকে ইশারায় ভেতরে যেতে বললেন। ঘরে ঢুকতেই মা এসে হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বললো, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে পাত্রপক্ষ এখনি চলে আসবে। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। মাত্র কয়েকটা ঘণ্টার মাঝে আমার জীবনের মোড়টাই পুরো ঘুরে গেলো। সেদিন কেউ শুনেনি আমার কথা। কারো মন গলাতে পারেনি আমার চোখের জল। সেদিনই আমার আকদ হয়ে গেলো। অবাক হতেও যেন ভুলে গেলাম আমি।

তার সপ্তাহখানেক পরেই নিজের চেনা ঘর, পড়ার টেবিল, বইখাতা সব ফেলে রেখে নতুন জীবনে পা দিলাম। যাওয়ার আগে পড়ার টেবিল আর তার উপরে রাখা বইখাতা গুলো ছুঁয়ে গেলাম। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি আমার প্রচুর ঝোঁক ছিলো। তা দেখে মা বাবাও বলতেন, "তোর ভাইটাকে দিয়েতো পারলাম না তোকে আমরা ডাক্তার বানাবো।" সেই মা বাবাই সময়ের সাথে কিভাবে পাল্টে গেলো! উচ্চমাধ্যমিক পার হতে না হতেই আমাকে কাধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো। মাঝেমাঝে বাবাকে একটা প্রশ্ন করতে খুব ইচ্ছে করতো কিন্তু সাহস হতোনা, "খুব কি বোঝা হয়ে গেছিলাম তোমাদের?"

আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন সাফ মানা করে দিলো আমার পড়াশোনার ব্যাপারে। বিয়ের তিনমাসের মাথায় আমার উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল হাতে পেলাম। গোল্ডেন পেয়ে পাশ করেছি, শুধু তাই নয় আমাদের কলেজের মধ্যে সবার মাঝে নাম্বারেও এগিয়ে আমি। কিন্তু কি লাভ তাতে! সেদিন শুধু চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা। বাবা মাকে অনেক বললাম আমার শ্বশুরবাড়ির লোকদের একটু বোঝাতে তারা যেন আমায় পড়তে দেয়। কিন্তু তারা বললেন, "বিয়ে হয়ে গেছে আর পড়ে কি হবে! এমনতো নয় যে রোজগার করে সংসার চালাতে হবে।"

বিয়ের ছয়মাসের মাথায় জানতে পারলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা। তখন সব ভুলে সংসারেই মন দিলাম। আমার স্বামীর মন আমি কখনোই পুরোপুরি পাইনি। তার শুধুমাত্র প্রয়োজনই ছিলাম আমি, কখনো প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারিনি। প্রেগনেন্সির সময়টাতে নাকি স্বামীরা স্ত্রীদের অনেক যত্ন নেয়। কিন্তু আমি যত্ন তো দূর উল্টে আগের চেয়ে আরো বেশি অবহেলা পেতে থাকলাম। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ব্যবহারও এমন ছিলো যেন আমি যেচে পরে তাদের ঘাড়ে এসে পড়েছি। বাবা মাকে বললেও সেই এক কথা এরকম একটু আধটু জিনিস মানিয়েই চলতে হয়। আমার বড় মেয়ের যখন বয়স তিনবছর তখন আমি আবারো অন্তঃসত্ত্বা হলাম। ভাবলাম এবার হয়তো মেয়ের বাবা একটু হলেও স্বাভাবিক আচরণ করবে। যত্ন না নিক অন্তত পাশে থেকে সাহস জোগাবে। কিন্তু এবারেও আমাকে ভুল প্রমাণিত হতে হলো। নিজের ভরা পেট নিয়ে বাড়ির সব কাজ করতে হতো। মেয়েটারও ঠিকঠাক খেয়াল রাখতে পারতাম না। মেয়ে যখন বাবার কাছে যেতো তখন দূরদূর করে তাড়িয়ে দিতো। নিজের সন্তানকেও যে কেউ এতোটা অবহেলা করতে পারে সেটা নিজ চক্ষে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না। ধীরেধীরে তার এমন আচরণের কারণ জানতে পারলাম। সে পরনারীতে আসক্ত। আগে মাঝেমাঝে একটু কথা কাটাকাটি হলেই আমার গায়ে হাত তুলতো। কিন্তু আমি যখন তার সত্যিটা জানতে পারলাম তখন থেকে সেটা আরো বেড়ে গেলো। সেদিন কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে আমাকে জোরে ধাক্কা দেওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে গিয়েছিলাম। রক্তে সারাঘর ভেসে গেলো। তা দেখে মেয়ের আমার সেকি কান্না! ওর কান্নার শব্দে এবার আমার শ্বশুর শাশুড়ি বেরিয়ে এলেন। এমন অবস্থা দেখে তারাও ভয় পেয়ে গেলেন। ততক্ষণে আমার স্বামী সেখান থেকে চলে গেছে। তারাই আমাকে হসপিটালে ভর্তি করায়। বাবা মাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েই তারা চলে যায়। সেদিন মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। এরপর আর দ্বিতীয়বার ঐ বাড়িতে পা রাখিনি। সদ্যজাত ছেলে আর আমার মেয়েটাকে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসি। বাবা মা আমাকে অনেক বুঝালেন ডিভোর্স না দিতে কিন্তু আমি আর শুনিনি তাদের কথা। এতদিনতো তাদের কথা শুনেই এত অত্যাচার সয়ে এসেছি।

একবছর সময় লেগেছিলো নিজেকে সামলাতে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিবন্ধন পরীক্ষা দেই। ভাগ্য সহায় থাকায় প্রথমবারেই টিকে যাই। এরপর থেকে শুরু হয় নতুন লড়াই। নিজের জীবন দিয়ে অনেককিছু শিখেছি। তবে আমার বাচ্চাদের যাতে এতোটা বিপর্যয়ের মুখে কখনো পরতে না হয় সেজন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি। লোকের কথা যাতে শুনতে নাহয় তাই বাবার বাড়িতে বেশিদিন থাকিনি চাকরি পেতেই কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থেকেছি। ধীরেধীরে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হল, যে ফ্ল্যাটে ভাড়া ছিলাম সেটাই কিনে নিয়েছিলাম।

এরপরের পেইজে লেখা জীবন কখন কাকে কোথায় এনে দাঁড় করায় সেটা কেউ বলতে পারেনা। আমার মেয়েটা মাত্র এমবিবিএস শেষ করে ডক্টর হিসেবে জয়েন করেছে। তার স্বপ্ন সে এফসিপিএস টাও করবে।ছেলের জীবনটাও এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারিনি। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে। এমন সময় জানতে পারলাম আমার ব্লাড ক্যান্সার হাতে আর মাত্র কটাদিন সময় আছে। কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছিনা।

আজ ছেলেটা খুব আবদার করছিলো একটা বাইকের জন্য। রাখতে পারলাম না। যদিও চাইলেই জমানো টাকা থেকে সেটা কিনে দিতেই পারতাম। কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের কথাটাও তো আমায় ভাবতে হবে।

শেষের দিকে একটা পেইজে লেখা,

আজ আবারো ছেলেটা একই আবদার নিয়ে আসলো। আবারো তাকে কষ্ট দিলাম। রেগেমেগে বললো, আমি নাকি তাকে ভালোই বাসিনা। ওর এমন কথায় খুব কষ্ট লাগলেও মনে নেইনি কথাটা। আমি না থাকি আমার বাচ্চাগুলো অন্তত ভালো থাকুক।

এরপরের কয়েকটা পৃষ্ঠা খালি। সর্বশেষ পৃষ্ঠাটায় লেখা,

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এবার আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। ডাক্তারও তো তাই বললো।

আমি জানি প্রাপ্তি মা তোর হাতে একবার হলেও এ ডায়েরিটা পড়বে। ডায়েরীর ভাজে যে চেকটা রাখা আছে সেটা ছাড়া আমার আর কিছুই দেওয়ার নেই তোদেরকে।

প্রাপ্তীর দুচোখ বেয়ে অবাধে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। প্রাপ্তী পেছন ঘুরে দেখলো। নাঈম দাঁড়িয়ে আছে। ডায়েরিটা লুকোতে চেয়েও পারলোনা। লাল মলাটের ডায়েরীটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো নাঈম। পড়া শেষ করে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো, "আমার কিচ্ছু চাইনা আপু। শুধু মাকে ফিরে আসতে বল। আমার শুধু মাকে চাই।"

দুই ভাইবোন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে এভাবেই কাঁদতে থাকে। তবে যে যায় সেকি আর ফিরে আসে?

সমাপ্ত,,

 

জাহানারা_রিমা

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।