'রোজা রেখেছেন আজকে?'
মেসেঞ্জারে প্রতিদিন এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা ভদ্র চেহারার লোকটাকে একদিন কড়া মেজাজে বললাম, 'আমি কবে হ্যাঁ এর পরিবর্তে না বলব, আপনি আসলে সেই অপেক্ষায় আছেন। তাই না?'
তিনি চুপ করে রইলেন। উত্তরে কিছু লিখলেন না। আমি জানি তার আসলে এই মুহুর্তে লেখার মতো কিছু নেই। মানুষের খারাপ দিকটা প্রকাশিত হয়ে গেলে সবাই তা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঢাকার চেষ্টা চালাতে পারে না, কিছু মানুষ মুখে কুলুপ আঁটে তখন।
আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি। কবিতা আমায় খুব টানে। ফেসবুকের নিউজফিডে অধিকাংশ পেজ এবং গ্রুপে একজনের কবিতা প্রায়ই ভাসে। তার লেখা কবিতার পাঠক রয়েছে হাজার হাজার। আমিও মুগ্ধ হয়ে একদিন কবিকে খুঁজে বের করলাম৷ তারপর মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে আমার কুশল বিনিময় হয় মেসেঞ্জারে৷
রমজান মাসের শুরু থেকে তিনিই নিয়মিত আমার খোঁজ খবর নিতে লাগলেন। কেমন আছি, কী করছি'র পাশাপাশি রোজা রেখেছি কী না এই প্রশ্নটাও তিনি করেন। প্রথম প্রথম স্বাভাবিক লাগলেও পরে রোজার বিষয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার এই প্রশ্ন করা দেখে খটকা লাগে মনে। বিব্রতবোধ করতাম উত্তর দিতে। তিনি হয়তো বুঝতেন।
ওইদিনের পর থেকে আর কখনো তার সঙ্গে
আমার কথা হয়নি। হওয়ার উপায়ও রাখিনি। যদি তার বিবেক তাকে নাড়া দেয় তাহলে সে ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই অনুতপ্ত হবে৷ আর যদি বিবেকের নাড়াকে গুরুত্ব না দিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে তার জন্য আফসোস, এত সুন্দর একটা পৃথিবীতে অসুন্দর মস্তিষ্ক নিয়ে পড়ে থাকবে বলে।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চুপচাপ বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। মোড়ের দোকানটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। পাশের বাসার আয়িশা ওর ছোট ভাই আদিবকে সঙ্গে করে দোকান থেকে ফিরছে।
গলির রাস্তায় কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আয়িশাকে দেখতেই ওরা আয়িশাকে ইঙ্গিত করে কিছু একটা বলছে। আশিয়া দ্রুত পায়ে আদিবের হাত ধরে হেঁটে বাসায় ঢুকে পড়লো। ওর চেহারা দেখে মনে হলো বেশ অস্বস্তিবোধ করছে।
বিকেলে আয়িশার সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞেস করলাম, 'দুপুরে রাস্তার ছেলেগুলো কী বলেছিলো তোকে?'
আয়িশা মুখটা কালো করে মাথা নিচু করে বললো, 'আমি পরশু থেকে রোজা ভাঙ্গা শুরু করেছি। এটা নিয়ে ওরা ভীষণ টিটকারি করছিলো আপু।'
আমি হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'ওরা কীভাবে জানে?'
'আদিব লুকিয়ে আমাকে খেতে দেখে ফেলেছিলো। ও তো ছোট মানুষ, বুঝতে পারেনি। চেঁচিয়ে সবাইকে বলে বেরিয়েছে। মা আর আমি ওকে বারন করলে ও আরও উৎসাহ নিয়ে সবাইকে জানিয়ে বেরিয়েছে।'
আয়িশা আমার দিকে তাকালো। ওর চোখে জল। অপমানের জল।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, 'আল্লাহ ওদের সুবুদ্ধি দিন।'
ফার্মেসি থেকে মায়ের জন্য ঔষধ নিয়ে বাসায় ফিরছি। গলির মোড়ে আসতেই চোখে পড়লো ওই ছেলেগুলোকে। তাকিয়ে দেখি আয়িশাও এদিকে আসছে৷ আমি পরিস্থিতি বোঝার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম।
আয়িশাকে দেখতেই ছেলেগুলোর মধ্যে থেকে একটা ছেলে হেসে বললো, 'আদিবের আয়িশা আপু কী আজকে রোজা রেখেছে নাকি আজকেও রাখেনি?'
কথা শেষ করতেই সঙ্গে থাকা সব ছেলেরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আয়িশা মাথা নিচু এগিয়ে আসছে দোকানের দিকে।
আমি গিয়ে ধড়াম করে ছেলেটার গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম, 'বাসায় তোর বোন আছে না? তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবি সে কবে রোজা রাখছে আর কবে রাখছে না। আয়িশাকে জিজ্ঞেস করার দায়িত্ব তোকে কেউ দেয়নি।'
ছেলেটা গালে হাত দিয়ে চুপ করে রইলো। পাশের ছেলেগুলো সব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়িশা হাঁটা থামিয়ে পেছন ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আমি লম্বা একটা দম ফেলে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'রোজা রেখেছো আজকে তোমরা?'
ওরা সবাই মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর দিলো।
'তোমরা সুস্থ মানুষ অথচ রোজা রাখছো না৷ লজ্জা তো তোমাদেরকে দেওয়া উচিৎ আর তোমাদের পাওয়া উচিৎ। অথচ তোমরা অভদ্রের মতো লজ্জা দিতে চাচ্ছো ওই অসুস্থ মেয়েটাকে। তোমাদের জন্য আফসোস হচ্ছে। তোমাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে অথচ তোমাদের নূন্যতম বিবেক জাগ্রত হয়নি।'
ছেলেগুলো চুপ করে মাথা নিচু করে রইলো। আমি আয়িশার হাত ধরে দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম। পেছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি না৷ ছেলেগুলোর ভেতরে এতটুকু সুবুদ্ধি উদয় হলে কর্মের জন্য অনুতপ্ত হবে। আর কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাউকে লজ্জিত করার জন্য অসভ্যতা করবে না।
আমরা বাসায় ফিরে এলাম। এরপর থেকে মোড়ে বা গলিতে ওই ছেলেগুলোকে আর কখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি৷ রাস্তায় কখনো দেখা হয়ে গেলে মাথা নিচু করে সবসময় হেঁটে গিয়েছে।
আমি জানি না ওরা ভেতর থেকে অনুতপ্ত হয়েছে নাকি চড়ের জন্য ভয় পেয়েছে। তবে আমি চাই ওরা বিবেকের তাড়ায় অনুতপ্ত হোক। ওরা ভেতর থেকে মানুষ হয়ে উঠুক।
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
nice story...!