Search

রম্য: ঝগড়া

  • Share this:

আজ নাকি বিশ্ব ঝগড়া দিবস ! পৃথিবীতে ঝগড়াকেও মানুষ উদযাপন করে সেটা আমার জানা ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টা ফলাও করে প্রচার হওয়াতে সেটা আমার নজরে এলো। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ কেন কোন প্রাণীই মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যারা ঝগড়া করে না। হাতি থেকে শুরু করে চামচিকা সবাই ঝগড়া করে। মানব কূলে নারী পুরুষের ঝগড়ার শুরু সৃষ্টির আদিকাল থেকে। গন্ধম খেতে নিষেধের পর শয়তানের প্ররোচনায় যখন কাজটা হয়েই গেলো তখন নিশ্চয় একটা চরম ঝগড়া হয়ে ছিল।

সকালে কোন দিন ঘুম থেকে সময় মতন উঠতে পারিনা। ফোনের অ্যালার্মটা বাজলে আস্তে করে বন্ধ করে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে যাই। কখন যে বন্ধ করি সেটাও টের পাইনা। গাঁজা অথবা মদ্যপান কোনটাই আমি করি না। তার পরেও কেমন করে যে এতো ঘুম কোথা থেকে আসে বুঝিনা। সীমা আমার অ্যালার্ম। সে প্রতিদিন রীতিমতন আমাকে টেনে হিচড়ে আমাকে ঘুম থেকে তোলে।

আজকে হলো তার ব্যাতিক্রম। সীমা আমাকে ডাকা ডাকি করলো না। বিষয়টা রাতেই আঁচ করতে পেরে ছিলাম । কারণ একটা ঝগড়া হয়ে গেছে কাল রাতে। ঝগড়ার বিষয়টা খুব হাস্যকর।

এক ভদ্রমহিলা লাইভে শাড়ির ব্যবসা করেন। রাত ১১টার সময় এই মহিলার লাইভ শুরু হয়।তিনিই মনে হয় পৃথিবীর এক মাত্র ব্যাক্তি যিনি মধ্যরাতে শাড়ির ব্যবসা করেন। যে শাড়িই তিনি হাতে নেন নিয়ে বলেন

- খুব মিষ্টি একটা কালার , দাম ১৬ হাজার ৫০০ টাকা।

সীমা আবার মাঝে মাঝে ফোনটা আমার মুখের সামনে এনে বলে

- দেখো , শাড়িটা খুব সুন্দর না ?

এমনিতেই চোখে ঘুম। তার উপর মধ্যরাতে শাড়ির ব্যবসা আর এই একই পেচাল ! আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম

- সারা দিন জীবন জীবিকার ধান্ধায় থাকি। রাতেও শান্তি নাই। প্লিজ একটু ঘুমাতে দাও। তা ছাড়া সব শাড়ির রং মিষ্টি হয় কেমন করে ? দুই একটা রং নোনতা হতে পারে না ?

তাতেই সীমার গালটা ফুলে গেলো। নাকের পেটিটা একটু মোটা হয়ে গেলো।

- ঘুমই কি তোমার জীবনের সব ? অফিস থেকে এসেই ঘুম, রাত ১০টা বাজলেই ঘুম , সকালে ঘুম, শুধু ঘুম আর ঘুম।

সীমা তীরটা ছুড়ে মারা জন্য ধনুকের তারে টানটা দিয়েছে মাত্র। আমি আমার ঢালটা প্রস্তুত করে রাখলাম।

-তোমার বংশ কি আসলেই চোধুরী ? আমার তো মনে হয়না ! চৌধুরী বংশের মানুষ এতো কৃপণ হয় ? তুমি কি আসলেই চৌধুরী নাকি রেল স্টেশনে কুড়িয়ে পাওয়া কেউ ? শাড়ি কিনে দিবে না সেটা বুঝলাম , ঘুমের বাহানা, এতো তেছরা কথা এসবের কি দরকার ?

আমি সীমাকে প্রতিআক্রমণ করে বললাম :

- মিষ্টি কালারের শাড়ি পরে কথা বলো তো তিতা ! শাড়ি কিনে দিয়ে তাহলে লাভটা কি ? কথা বার্তা ঠিক করো তার পরে দেখা যাবে।

কথাটা সীমার হৃদয় বিদীর্ণ করে চলে গেলো।গালটা আরো ফুলে উঠলো। ফোনটা নিয়ে বেডরুম থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

আমার মাথায় প্রথম চিন্তা আসলো আমাকে কাল সকালে ডাকা ডাকির কাজটা কে করবে ? মনে মনে ভাবলাম এই জন্যই মনে হয় কোন কোন ধর্মে বহু বিবাহের বিধান আছে। ব্যাকআপ বলে কথা !

পরের দিন আমার আয়েশি ঘুম ভাঙলো সকাল ৯ টায়। অফিসের মিটিং ছিল সাড়ে আটটায়। মিটিং মিস। ভয়ে ভয়ে অফিসে গিয়ে শুনি বড় কর্তার পা মচকে গেছে তাই তিনি অফিসেই আসেননি । আমার মতন উনারও নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। তা না হলে রাতে রাতে পা মচকাবে কেন ভদ্রলোকের ? ভদ্রলোকের স্ত্রী একটু লম্বা চওড়া। ভাগ্য ভালো আমার সে রকম কিছু হয়নি।

বংশ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ ! চৌধুরী পরিবারের প্রতি কটাক্ষ ! বিষয়টা কোন ভাবেই মাথা থেকে যাচ্ছে না। পক্ষান্তরে সকাল থেকে নাস্তা , দুপুরের খাবার সব কিছু যাচ্ছে রেস্তোরার উপর। সীমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। সে এই সুযোগে আমাকে কিছুদিন ভাতে মারবে , পানিতে মারবে আর বিছানায়ও মারবে। ক্রান্তিকালে আমার চিকন বুদ্ধি ভালো কাজ করে। অনেক ভেবে চিন্তে একটা চিকন বুদ্ধি এলো মাথায়। যুদ্ধে জয় করতে হলে অনেক সময় সাময়িক পরাজয়ে মেনে নিতে হয়। ফাটাফাটি একটা শাড়ি কিনে দিতে হবে সীমা কে। কিন্তু এই কাজে আমার অভিজ্ঞতা একেবারে শুন্য। একটা পছন্দ করে আনার পর দেখা যাবে সেটা নাকি দাদির আমলের স্টাইল ছিল।

যৌবনের শুরুতে একটু রংবাজ টাইপের ছিলাম। সেই সুবাদে অনেক গুলো বান্ধবী ছিল আমার। সব গুলো অবশ্য এখন নির্মলেন্দুর কবিতার ভাষায় ” ডাকাত স্বামীর ঘরে তিন সন্তানের জননী “

ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে তারা স্বেচ্ছায় আবার আমার জালে ধরা দিয়েছে। মজার বিষয় হলো যারা তখন বিখ্যাত ছিল তারা এখন অখ্যাত আর যে গুলো তখন অখ্যাত ছিল তারা এখন বিখ্যাত। এটাই মনে হয় জীবনের ধর্ম। তার মধ্যে অবশ্য একজন আছে যিনি হচ্ছে পুরান চাল। তিনি তখনো বিখ্যাত ছিলেন এখনো বিখ্যাত। শীর্ষস্থানীয় নারী উদ্যোক্তা। ঘুম থেকে উঠেন ১২টার সময়। সাঁজগোজ করে বের হয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যান লাঞ্চের পরে। ফোন দিলে প্রথমে উনার পি এ ধরেন। নাম ঠিকানা জানার পরে বলে

- ম্যাডাম একটু ব্যস্ত আছেন। উনি ফ্রী হলেই আমি উনাকে ইনফর্ম করছি ।

সেই ইনফর্ম আর জীবনেও করা হয় না।

এই পুরান চাল কে একটা বিশেষ সময়ে ফোন দিলে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে মধ্যে রাতের পর। ফোন দেবার সাথে সাথে সাথে ফোন ধরবে। ধরেই বলবে

- জামাই বাথরুমে , যা বলার তারাতাড়ি বল ?

একদিন আমি বলেই বসলাম

- তোর জামাই কে ডাক্তার দেখা তো ! রাতে কল দিলেই শুনি বাথরুমে।

উত্তরে যা বললো সেটা অবশ্য যুক্তি সঙ্গত। বাঙালি কাজের কথা বলে সবার শেষে। তাই তাড়াতাড়ি কাজের কথা সেরে ফেলার জন্য এই বাথরুমের ডায়লগটা ছাড়ে।

যাই হউক মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময় নাই আমার। যেমন করেই হউক উনাকে আমাকে দরকার। ক্রান্তিকালের চিকন বুদ্ধি আবার জ্বলে উঠলো।

পি এ কে ফোন দিয়ে গলা গম্ভীর করে বললাম

- আমি কি ম্যাডামের সাথে একটু কথা বলতে পারি ? আমি উনার ছেলের স্কুল থেকে বলছি।

বিদ্যুৎ বেগে লাইন চলে গেলো ম্যাডামের কাছে। ম্যাডাম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন

- হ্যালো

- তোর পি এ একটা মহা ফাজিল। ফোন দিলেই বলে ম্যাডাম ব্যস্ত। তাই এই রাস্তা ধরলাম

- ও মাই গড.... তুই আমার আত্মা উড়াইয়া দিসিলি। আমি তো ভাবছি ছেলে নিশ্চয় স্কুলে কোন আকাম করছে !

- আরে না , আকাম করছি আমি !

রাতের ঘটনা খুলে বলতেই ম্যাডামের মনে সীমার জন্য উথাল পাতাল শুরু হয়ে গেলো।

- তুই আসলেই একটা কিপ্টা ! জীবনে এক প্লেট ফুচকাও তো মনে হয় কিনে দেস নাই আমাকে !

আমি উত্তরে বললাম

- আমার টাকায় যত প্লেট ফুচকা খাইসো জীবনে এতো গ্লাস পানিও খাও নাই তুমি !

কথাটা সত্যি , তাই তর্কে না গিয়ে বললো

- আমারে ফোন দিসস কেন ? আমি কি করতে পারি ?

- তুই তো ফ্যাশন আইকন । ৫৩৪১২ জন ফলোয়ার তোর। একটা ঝাক্কাস মার্কা শাড়ি পছন্দ করে দেয় সীমার জন্য। তোর ফ্যাশন সেন্স ভালো। আমি তো শাড়ির কিছু বুঝিনা !

- আচ্ছা বুঝচ্ছি !

- আজকেই লাগবে

- আজকেই লাগবে ?

- হ্যা আজকেই লাগবে

- এক কাজ কর অফিস করে সোজা চলে আয়।

অফিস শেষ করে চলে গেলাম।ম্যাডাম এক দোকানের অর্ধেক শাড়ি নামিয়ে ফেলে একটা শাড়ি পছন্দ করলেন । নাম তানতুজ না ফানতুজ কি যেন ! ক্ৰেডিট কার্ডের অর্ধেক লিমিট এক ঘষাতে শেষ।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে খুব ভাব নিয়ে সীমাকে বললাম

- চৌধুরী বংশ নিয়ে কথা বলার আগে একটু বুঝে শুনে বলবা। চৌধুরী পরিবারের লোকজন এতো ছোট লোক না। এই নাও শাড়ি ! দেখো পছন্দ হয়েছে কি না ?

সোমা শাড়ির বাক্স খুলে বললো

- ওয়াও! এটা তুমি কোথায় পেলা ? আমি তো অনেক দিন ধরে খুজছিলাম , পাচ্ছিলাম না। এটা তো অনেক এক্সপেন্সিভ। ভেরি রেয়ার কালেকশন !

তার পরে একটু সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো

- তুমি আবার শাড়ি এক্সপার্ট কবে হলে ?

আমি পূর্ন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম

- চৌধুরীরা সব কাজের কাজী !

রাতের খাবারে দুটো অতিরিক্ত পদ যুক্ত হয়ে গেলো শাড়ির কল্যানে। একটা খুশি খুশি ভাব নিয়ে দুজনই ঘুমাতে আসলাম। সীমা এর মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কোরবানি ঈদে সে শাড়িটা পড়বে।

ঠিক তখনই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে সীমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে ম্যাডামের কণ্ঠ :

- এই সীমা , শাড়িটা পছন্দ হয়েছে ? আমি না একটু ডাউট ফুল ছিলাম বুঝছো। পাড়টা একটু চওড়া আর ভিতরে কাজটার কলার কম্বিনেশনটা আমার অনেক ভালো লেগেছে তাই .........

মধ্যে রাতে পাকা ধানে এই ভাবে মই দেয়াটা কেমন হলো বলেনতো ? আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন ! সারা বছর ধরেই মনে হয় ঝগড়া দিবস উদযাপন করতে হবে !

(সমাপ্ত)

 

লেখক : মুনির আ চৌধুরী

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।