Search

শেষ বয়সের প্রাপ্তি

  • Share this:

আমার মা গত হয়েছেন একমাস হয়ে গেছে। মা মারা যাবার পর থেকে ইদানিং সালমা আন্টির চলাচল আমাদের বাড়িতে বেশ বেড়ে গেছে। এমনকি তিনি নিঃস্বার্থভাবে আমাদের ঘরের যাবতীয় অনেক কাজই করে দেন।

সালমা আন্টির বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি কিন্তু তবুও তিনি এখনও পর্যন্ত বিয়ে করেননি। কিন্তু কী কারণে বিয়ে করেননি তা এখনও পর্যন্ত আমরা কেউই জানতে পারিনি। গ্রামের অনেক কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষই বলেন যে তাঁর উপর নাকি শয়তানের নজর পরেছিলো তাই তাঁর বিয়ে হয়নি। গ্রামের মানুষজনের এসব কথায় আমি একদমই বিশ্বাসী না তাছাড়া আন্টির চেহারা আহামরী এতোটা সুন্দর না হলেও ততোটাও খারাপ না। চেহারার মধ্যে বেশ একটা মায়াবী ভাব আছে।

একটি অবাক করা বিষয় হলো মা বেঁচে থাকতে তিনি সহজে আমাদের বাড়িতে পা রাখতেন না আর যদি আসতেনও তবে পাঁচ মিনিটের অধিক সময় থাকতেন না। আর তিনি যখন আসতেন তখন আমার মায়ের মুখখানি বেশ কালো হয়ে যেত কিন্তু কী কারণে আমার মা তাঁর প্রতি অখুশি ছিলেন তা আমরা কেউই অবগত ছিলাম না। অথচ আমরা পাঁচ ভাইবোন আন্টিকে খুবই ভালোবাসতাম এমনকি আন্টির বাসায় যখন আমরা কেউ যেতাম তখন তিনি অনেকটা উৎফুল্ল হয়ে আমাদের জন্য কী করবেন বা কী খাওয়াবেন তার জন্য আকুল হয়ে উঠতেন।

.

মা মারা যাবার পর আমাদের ঘরটাও বেশ ফাঁকা হয়ে যায়। আমি সবার ছোট হওয়াতে এখনও পর্যন্ত বিয়ে করিনি কিন্তু আমার বড় তিনবোন আর ভাই অনেক আগেই বিয়ে করেছেন। ভাই ব্যাংকে চাকুরী করার সুবাধে ভাবীও শহরে তাঁর সাথেই থাকেন। আমার মায়ের ইচ্ছা ছিলো মৃত্যুর আগে আমার বিয়েটা দিয়েই যাবেন কিন্তু প্রভুর হুকুমকে উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি পরলোকগমন করেন। মায়ের মৃত্যুতে আমার বাবা অনেকটাই ভেঙ্গে পরেছিলেন কেননা যেখানে এখনও পর্যন্ত আমার দাদী বেঁচে আছেন সেখানে মায়ের মৃত্যুটা কখনোই কাম্য ছিলো না। তবুও সালমা আন্টি প্রতিনিয়ত আমাদের বাড়িতে এসে ঘর গুছানো কিংবা রান্নাবান্নার কাজে সহযোগীতা করার ফলস্বরূপ মায়ের শূণ্যতা ততোটা অনুভব করছিনা ইদানিং।

সেদিন হঠাৎই আমার দাদী আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বলেন,

-তোরে একটা জিনিস বলতে চাইছিলাম। যদিও এতোদিন বলিনাই কিন্তু এহন যেহেতু তোর মা বাঁইচা নাই তাই চিন্তা করলাম বইলাই ফালাই।

দাদীর কথা শুনে আমি অনেকটা আগ্রহের স্বরে তাকে বলে উঠলাম,

-হুম বলো।

-শোন! সালমার কেনো বিয়া হয় নাই জানোস?

-কেনো?

-মানুষে যে বলে ওর উপর নাকি শয়তানের নজর পরছে আসলে এইডা ডাহা মিথ্যা কথা। ও নিজের ইচ্ছাতেই বিয়া করে নাই আর সেইটার কারণও আছিলো তোর বাপে নিজেই।

দাদীর কথা শুনে সালমা আন্টির প্রতি আমার জানার আগ্রহের সীমা যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলো। আমি অনেকটা উৎফুল্ল নয়নে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম,

-কী বলছো? বাবা কেনো তাঁর বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে?

-পিরিতের টানে বুঝছোস পিরিতের টানে। বিয়ার আগে সালমা তোর বাপেরে অনেক ভালোবাসতো। তোর বাপেও নাকি ওরে ভালোবাসতো তবে সেইটা নিয়া আমার সন্দেহ আছে।

-কেন দাদী? আর বাবা যেহেতু আন্টিরে ভালোইবাসতো তাইলে মা কে বিয়ে করলো কেন?

-বাইধ্য হইয়া। তোর দাদার সাথে সালমার বাপের জমি নিয়া একটা বিশাল ঝামেলা আছিলো। আমি চাইছিলাম তোর বাপের সাথে যেন সালমার বিয়াটা হয় কিন্তু তোর দাদার উপরে আমি কোনোদিন কথা কইতে পারি নাই এমনকি তোর দাদাও জানতো যে সালমার সাথে তোর বাপের পিরিতের সম্পর্ক আছে কিন্তু তিনি ইচ্ছা কইরাই তোর বাপেরে অন্য জায়গাতে বিয়া দিয়া দেয়। এহনকার যুগের মতো সেইকালে তহন পোলারা নিজের বাপের উপরে যাইয়া নিজের পছন্দের কথা জানানোর সাহস পাইতো না আর তোর বাপেও পারেনাই। কিন্তু তোর বাপে যদি একটু জেদ করতে পারতো তাইলে ঠিকই সালমারে বিয়া করতে পারতো। কিন্তু তোর বাপে তা করেনাই আর সেই জন্যই সালমার প্রতি তোর বাপের ভালোবাসা নিয়া আমার কাছে সন্দেহ আছে। আর এদিকে সালমা আছিলো বেশ একগুঁইয়া মাইয়া। তোর বাপের উপরে জেদ কইরা আর কোনো পুরুষেরে সে বিশ্বাস করতে পারেনাই তাই হাজার বার চেষ্টা কইরাও সালমার বাপে ওরে কোনো জায়গাতে বিয়া দিতে পারেনাই। তোর বাপের বিয়ার পর দশবছরের মধ্যে সালমা এই বাড়িতে পা দেয় নাই। তারপর যেদিন তোর দাদা মারা যায় সেইদিন থেকে আশা শুরু করছিলো। তোর মা সালমা আর তোর বাপের পিরিতের কথা অল্প কিছুডা জানতো। তাই সালমা এই বাড়িতে আসলেই মুখ কালা কইরাই বুঝাইতো চাইতো যে তাঁর এই বাড়িতে না আসাই ভালো। তাই সালমাও বেশি আইতো না।

এই বলেই দাদী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। আর আমি তখনো দাদীর দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে ভাবছি,

এতোবড় একটি সত্য এতোটা বছর গোপন ছিলো অথচ আমরা কেউই জানতাম না?

বিকালে যখন সালমা আন্টি আমাদের বাসার কাজকর্ম সেড়ে চলে যাবেন তখন তাকে দাঁড় করিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-আচ্ছা আন্টি তুমি কেনো বিয়ে করোনি বলোতো?

তিনি কিছুটা মুচকি হেসে বললেন,

-তোরাতো জানোসই যে গ্রামের মানুষ বলে আমার উপর নাকি শয়তানের নজর পরেছিলো তাই কেউ আমাকে বিয়ে করতে চায়নি।

-কেউ বিয়ে করতে চায়নি নাকি বাবার প্রতি রাগ করে বিয়ে করোনি?

আমার কথা শুনে তিনি খানিকটা হকচকিয়ে উঠে বললেন,

-তোর বাবার কারণে কেনো হবে? আমি নিজের ইচ্ছাতেই বিয়ে করিনি।

-এইতো কেঁচো খুরতে সাপ বের হয়েছে। প্রথমে বললা শয়তানের নজর আর এখন বলছো নিজের ইচ্ছাতে? আচ্ছা বাবা যেসময় তোমাকে কষ্ট দিয়ে দাদার কথায় অন্য জায়গাতে বিয়ে করতে রাজি হলো তখন তুমি লাঠিটা নিয়ে এসে তাঁর মাথায় একটা বারি দিলে না কেন বলোতো?

-সন্ধ্যা হয়ে গেছে বাসায় যেতে হবে। তোর এসব কথা শোনার টাইম নেই এখন।

এই বলেই যখন আন্টি চলে যেতে ধরলেন তখনই খপ করে তাঁর হাতটা আমি ধরে বললাম,

-না তুমি যাবেনা। আজকে তুমি আমাদের বাসায় থাকবে। আজকে তোমার সাথে বাবার একটা বোঝাপরা করবো যে তিনি তোমার সাথে এরকমটা কেন করলেন?

আমার কথা শুনে আকস্মাৎ তিনি কেঁদে দিলেন। আমি বুঝতে পারলাম এটা কোনো সাধারণ কান্না নয় বরং বহুবছরের জমিয়ে রাখা কষ্টের কিছুটা প্রকাশ মাত্র।

রাতে যখন বাবা বাসায় ফিরলেন তখন তাকে দাদীর বেডরুমে নিয়ে আসলাম। দাদীর রুমে বাবা সালমা আন্টিকে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হলেন বটে তবে পরক্ষণেই কিছুটা ইতঃস্তত ভঙ্গিতে বললেন,

-আম্মা, আমারে ডাকছিলেন?

বাবার কথায় আমি বলে উঠলাম,

-বাবা তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।

-তো আমাকে আলাদা করে বললেইতো পারতি। এখানে ডাকার কী দরকার ছিলো?

-কেনো আন্টি থাকার কারণে কী তোমার সমস্যা হচ্ছে?

আমার কথায় তিনি খানিকটা থতমত খেয়ে বললেন,

-না না সমস্যা হবে কেন? কী বলবি বল?

-আমরা ঠিক করেছি সালমা আন্টির সাথে তোমাকে বিয়ে দিবো।

আমার কথা যেন অনেকটা বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত করলো সালমা আন্টি আর বাবার কানে যদিও দাদী কিছুই বলেন নি। সালমা আন্টি বসা থেকে উঠেই বললেন,

-এসব কী বলছিস তুই?

অপরদিকে বাবা বলে উঠলেন,

-বেয়াদবির একটা সীমা থাকা দরকার? থাপ্পর দিয়া দাত ফালাইয়া দিমু। এগুলা কী বলিস?

বাবার এহেন আক্রোশমাখা কন্ঠ শুনে দাদী বলে উঠলেন,

-তোরে থাপ্পর দিমু। আমার নাতি যা কইছে ঠিকই কইছে। বিয়ার আগে পিরিত কইরা মাইয়াডারে কষ্ট দিয়া আরেক জায়গায় বিয়া করছিলি কেন? ঐসময় যেহেতু তোর বাপের কথা শুইন্না বিয়া করছিলি তাই এহন আমার কথায় তোর আবার বিয়া করতে হইবো। আর কোনো কথা না।

দাদীর কথা শুনে বাবা কিছুটা নরম স্বরে বলে উঠলেন,

-আম্মা, এই বুড়া বয়সে যদি বিয়া করি তাইলে এলাকার মানুষ কী কইবো ভাবতে পারছো? আর তাছাড়া আমার বড় বড় চারটা ছেলেমেয়েরে অলরেডি বিয়ে দিয়ে ফেলেছি ওরাও তো বলবে যে মা মরতে না মরতেই বাবার ভীমরতি ধরছে।

-বাবা, তোমাকে সে সব নিয়ে ভাবতে হবে না। আপুদের আর ভাইয়াকে আমি অলরেডি জানিয়ে দিয়েছি। তাঁরা কালই চলে আসবে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে।

আমার কথা শুনে এবার বাবা অনেকটা তেড়ে আসতেই দাদীর ধমকে পুনরায় পিছু হটলেন।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এবং দাদীর একগুঁয়েমির কারণ অবশেষে বাবা রাজি হলেন।

আমি ইতঃপূর্বে আপুদের এবং ভাইয়াকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেছিলাম। ভাইয়া কিছুটা দ্বিমত করলেও অবশেষে আর না করেননি। এসব ঘটনা মুহূর্তেই এক কান দুই কান করে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পরলো। কেউ কেউ এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কিংবা কটু কথা বললেও অধিকাংশজনই দ্বিমত করেননি। তবে সকলের নিকট সবথেকে অবাক করা বিষয় ছিলো সালমা আন্টির ব্যপারটা কারণ তিনি শেষ বয়সে এসে কেনইবা বিয়ের পিরিতে বসলেন সেই প্রশ্নটা সবার কাছেই উঁকি দিচ্ছিলো।

কেঁটে গেছে একমাস...

মায়ের মৃত্যুটা আমার মনে বেশ কষ্টের সঞ্চার করলেও অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই আমি সালমা আন্টির ভিতরে মায়ের অস্তিত্বটা এ কদিনে বেশ অনেকটাই অনুভব করতে পেরেছি। এ কদিনে কখনোই আমার মনে হয়নি এই হৃদয়ে মায়ের স্থানটা বিন্দুমাত্র শূণ্যতায় ছেয়ে ছিলো।

সেদিন যখন ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরলাম তখনি আমার চোখ যায় পুকুর পাড়ে পেতে রাখা বেঞ্চটার দিকে। সেখানে অনেকটা কাছাকাছি হয়েই বসেছিলেন আমার বাবা আর সালমা আন্টি সম্বোধন করা আমার নতুন মা। তাঁদের এতোটা কাছাকাছি দেখে নিজের অজান্তেই আমার মুখে ফুটে কিছুটা হাসি বেরিয়ে এলো। মনে হচ্ছে দুটো বৃদ্ধ পাখি শেষ বয়সে তাঁদের ভালোবাসাটা বিনিময় করছে আর এরকম শেষ বয়সের ভালোবাসার তীক্ষ্মতা বোধহয় একটু বেশিই থাকে। থাকুক না একটু তীক্ষ্মতা থাকুক না একটু প্রাপ্তি সমস্যাটা কোথায়? তাঁদের এহেন পবিত্র ভালোবাসাইতো আমাদের ভবিষ্যত অনুপ্রেরণার হাতিয়ার।

.

(সমাপ্ত)

.

Misk Al Maruf

Tags:

About author
আমি গল্প এবং বই প্রেমিক একজন মানুষ। গল্প এবং বই পড়তে খুবই ভালোবাসি। যেখানেই যে গল্প অথবা কাহিনী খুজে পাই সেগুলো সংগ্রহ করি এবং আপনাদের সাথে শেয়ার করার চেষ্টা করি। আমি নিজেও কয়েকটি গল্প লিখেছি তবে সেগুলোর সংখ্যাটা খুবই সামান্য।