১.
মোবাইলের রিংটোন বাজছে। সে দিকে অহনার মনোযোগ নেই। মনোযোগ আয়নায়। মাথায় হিজাব দিচ্ছে, আবার খুলে ফেলতেছে - ঠিক মনমতো হচ্ছে না। ওর নিজের কাছে নিজেকেই যদি হিজাবে পছন্দসই না লাগে, নিলয়ের লাগবে কিভাবে? প্রথমবার প্রেমিকের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে সে।
মোবাইলের রিংটোন শেষ হতে না হতেই আবার বাজতে শুরু করে। দ্রুত হিজাব পরে নেয়। আয়নার দিকে তাকায়। না, এখন ঠিক আছে। অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।
ম্যাচ হতে দ্রুত বের হয়। তালতলা হতে কলেজ মোড়। খুব বেশি দুরত্ব নয়। দুরত্ব আরো কমিয়ে আনতে সরকারি কলেজের পেছনের ছোট গেট দিয়ে কলেজে প্রবেশ করে। এবার ফোন রিসিভ করে।
হ্যালো। ওপর প্রান্ত হতে শব্দ আসে।
দাড়াও। আসতেছি, দুই মিনিট। এ প্রান্ত হতে বলে অহনা।
তাড়াতাড়ি আসো।
২.
নিলয় কলেজ মোড়ে দাড়িয়ে অহনার অপেক্ষায়। অহনার সাথে দেড় মাসের সম্পর্ক। সম্পর্ক বলতে প্রেম। সে হিসাবে অহনা নিলয়ের প্রেমিকা।
আজ দুজনে ধরলা ব্রিজ ঘুড়তে যাবে রিকশায়। অনেক দিন ধরলার ফ্রেশ হাওয়া খাওয়া হয় না, প্রেমিকার হাতে হাত ছুয়ে শান্ত নিরিবিলি ধরলার তীরে বসে ফ্রেশ হাওয়া খাবে সে। শহুরে বিষাক্ততায় দম বন্ধ হয়ে আসে। আর কতো!
মোবাইলের স্ক্রিন এর দিকে তাকায়। দুপুর একটা পনেরো। অনেক্ষন হতে দাড়িয়ে। অহনা নেই, তালতলা হতে কলেজ মোড় আসতে এত সময় লাগে! মনে মনে বিরক্ত হয়ে ওঠে অহনার উপর।
মোবাইলের স্ক্রিনে অহনার নম্বর ভেসে ওঠে। অহনাকে কল দিবে। তখনই অহনাকে দেখতে পায় সে। খুব সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে দুর হতে। অহনা সত্যিই সুন্দরী। আর সেজেছেও। মাথায় হিজাব পরেছে। সব মিলিয়ে পরীর মতো দেখাচ্ছে তাকে। শুধু দুটো ডানা থাকলে সে উড়ে যেত তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে দুরের সেই পরীর রাজ্যে!
তারপর পরীরে কাছে পাওয়ার তীব্র কামনা হঠাতই সে উপলব্ধি করে ।
৩.
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে দুজন রিকশায় হুড তুলে। ব্যাটারিচালিত রিকশা ছুটছে ধরলা ব্রিজের দিকে। রিকশাচালকের দৃষ্টি রাস্তায়। রাস্তায় মানুষজন নেই। মাঝে মাঝে দু একটা অটো আর মোটরসাইকেল ছুটছে। গ্রামের দুপুর প্রায় মধ্য রাতের মতোই নিরব, শহরের চিত্র ভিন্ন। কি দিন, কি রাত? নিরবতা সেখানে সূর্যে প্রানের আবাদির মতোই! তবুও দুপুরে রাস্তা নির্জন হয়ে ওঠে কখনো সখনো । আজ তেমনি একটা দিন।
নিলয় প্রথমে অহনার কাধে হাত রাখে । অহনা তাকায় নিলয়ের দিকে। নিলয় হাঁসে। অহনা চুপ থাকে। নিলয়ের হাত ধীরে ধীরে নিচে নামে। অহনা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে নিলয়ের হাত সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। পারে না। নিলয় আরো চেপে বসে ওর শরীরের সাথে। এক সময় নিলয়ের হাত হিজাবের নিচে বুকে স্থির হয়।
হিজাবের নিচে সে হাত অবশ্য কেউ বুঝতে পারবে না। অহনা আর বাধা দেয় না। স্থির হয়ে বসে। শরীর শক্ত হয়ে আসে। ঘামতে শুরু করে। জড়তা ওকে গ্রাস করেছে। ও কখনো কল্পনাও করে নি এমন হবে। নিলয় ওর সাথে এরকম করবে। ওর বান্ধবীদের অনেকেই সম্পর্কের ট্রাষ্টির জন্য রাত কাটিয়েছে। কিন্তু সে তো আর ওর বান্ধবীদের মতো না। সে কি ভুল করতে যাচ্ছে, নিজেকে প্রশ্ন করে। কোন সদুত্তর পায় না। সদুত্তর না পেয়ে নিলয়ের হাতের ছোয়া মেনে নিতে চেষ্টা করে। স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। নিলয়কে বলে,
একটা হিজাব কিনতে হবে। ফেরার পথে সুপারমার্কেট হয়ে ফিরবো।
সে না হয় ফিরবো। ধরলা ব্রিজ না গিয়ে আসিফদের বাড়ি হতে ঘুরে আসলে কেমন হয়? এই তো সবুজ পাড়ায় বাড়ি। নিলয় বলে। নিলয়ের মগজে তখন অন্য ভাবনা।
অহনা নিলয়ের দিকে তাকায়। নিলয়ের চোখের ভাষা বুঝতে অসু্বিধে হয় না। সে চোখে এখন স্পষ্ট কামনা। আসিফদের বাড়ি ঘুরে আসার মানেটা সে বোঝে। অহনা নিরব থাকে। ভাবে, কি করা উচিৎ।
' মামা কোথায় যাবো এখন? ধরলা না সবুজ পাড়া? ' রিকশাচালক কথা বলে ঘাড় ফেরায় পেছনে। মুখে বাঁকানো হাঁসি। নিলয়ের হাত তখনো অহনার বুকে।
কোথাও না। রিকশা থামান, আমি নেমে যাবো । নিলয় কিছু বলার আগেই অহনা জবাব দেয়। রিকশাচালকের হাঁসি যে নোংরা ইঙ্গিত ছিল তা সে বুঝতে পেরেছে । এতক্ষন হতে রিকশাচালক যে ওদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে ভাবতেই ঘৃনা হতে শুরু করে। ঘৃনা হতে শুরু করে নিজের প্রতি। পাশে বসা নিলয়ের প্রতি ।
আসিফদের বাড়ি হতে ঘুড়ে আসা কথাটা দিয়ে নিলয় যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তাতে নিলয়কে এখন আর ওর ভালো ছেলে বলে মনে হচ্ছে না। এ কি করছে সে? ভুল করেছে সম্পর্কে জড়িয়ে। বিবাহপূর্ব প্রেম নামক সম্পর্ক গুলোই ভুল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর ফলাফল খারাপই হয়। এখন সে বুঝতে পারতেছে। নিলয়ের হাত ওর বুকে! এর চেয়ে নোংরামি কি হতে পারে! বিবেকের নিউরনগুলো সজাগ হয়।
হঠাতই নিলয়ের হাত সরিয়ে দেয়। নিলয় জোর করে, তবে সে পরাজিত হয় । মধ্য রাস্তায় জোরজবরদস্তি চলে না! অহনার নিজের প্রতি ঘেন্না হয়। ধীরে ধীরে তা প্রকট আকার ধারন করে।ঘেন্না হলে অহনার বমি আসে । হড়হড় করে বমি করে সে। সব বমি ছিটকে নিলয়ের শরীরে পরে।
৪.
গোসল দিয়ে এসে ঝিম মেরে চেয়ারে বসে অহনা। অনুভব করে, তার বুকে তখনো যেন নিলয়ের হাত। আজ এ কি করেছে সে! এতটা নিচে নেমেছে! এতটা নিচে! মধ্য রাস্তায় রিকসায়! ছিঃ
অহনার রুমমেট রুমকি রুমে প্রবেশ করে। অহনাকে ঝিম ধরে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়। এমন ভাবে বসে থাকার মেয়ে অহনা নয়।
কি রে ফিরলি? প্রথম ড্যাটিং কেমন উপভোগ করলি। প্রশ্ন করে রুমকি ।
অহনা কিছু বলে না। হঠাৎ করেই কাঁদতে শুরু করে। রুমকি ঠিক বুঝতে পারে না। অহনার কান্নার কারন কি? বোকার মতো চেয়ে থাকে। তার পর রুমকির পাশে গিয়ে বসে।
কিরে কাঁদছিস যে। কিছু হয়েছে। প্রশ্ন করে।
সব খুলে বলে সে অহনা। রুমকি নিরবে সব শোনে। বলে, তুই অনেক ভালো মেয়ে রে অহনা, অনেক ভালো মেয়ে। বলি এই সব তোর জন্য না। ভালো মেয়েরা এসবে জড়ায় না। আর জড়ালেও ভালো মেয়ে থাকে না। প্রেম ভালোবাসার কথা বললেও এখানে দেহের টানটাই আগে! ঠিক বিশ্বাস করা যায় না কাউকে! এই মিথ্যে সম্পর্কে জড়িয়েই তো ধর্ষিতা হয় হাজারো মেয়ে প্রতিদিন ।
৫.
মোবাইলের রিংটোন বাজছে। অহনার মনোযোগ নেই মোবাইলের প্রতি। সে ছবি আঁকতে ব্যাস্ত। একটা কুকুরের ছবি আর একটা পুরুষের ছবি। পুরুষটা নিলয় । দেখতে চায় দুটোর মধ্যে মিল অমিল গুলো কোথায়?
রুমকি পড়ছিল। অহনা ফোন রিসিভ করছে না দেখে বিরক্ত হয়ে ওঠে। বলে, কিরে ফোন রিসিভ কর। আমি পড়ছি। ডিস্টার্ব ফিল করছি।
অহনা মোবাইল হাতে নেয়। পরিচিত নম্বর । নিলয় কল দিয়েছে। ফোন রিসিভ করে। অপর প্রান্ত হতে নিলয়ের কন্ঠস্বর ভেসে আসে , অহনা, সরি। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি, মাথা ঠিক ছিল না! হঠাৎ খুব সিরিয়াস হয়ে গেসলাম। কি করতে কি করেছি, কি বলতে কি বলেছি....
কুত্তার বাচ্চা, তুই আর কখনো কল দিবি না। বলেই অহনা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। রুমকি অহনার দিকে তাকায়, অবাক দৃষ্টিতে। ততক্ষনে অহনা রঙ পেন্সিল হাতে নিয়েছে। সে ছবি আঁকবে, পুরুষ আর কুকুরের ছবি। তার এখন অনেক কাজ।
৬.
নিলয় অফছোস হচ্ছে খুব । টেবিলের উপর জবরদস্তি দু তিনটে কিল বসিয়ে দেয়। কেন যে সে ভুলটা করলো । অহনার বুকে হাত না দিলেও পারতো। ভুলের জন্য এত সুন্দর মেয়েটা হাতছাড়া হলো! সময় নিয়ে এগুতে হতো!
মোবাইল হাতে নেয়। একটা পরিচিত নম্বরে কল দেয়। একজন হাতছাড়া হয়েছে তো কি? নতুন শিকারের খোজ করতে হবে। ওপর প্রান্তের ছেলে বলে, হ্যালো।
আবির?
বল।
রাহেলার নম্বরটা ম্যানেজ করে দিস তো। প্লিজ দোস্ত ।
৭.
সাতমাস পর।
অহনা টেলিভিশন রুমে বসে গল্প করছিল অন্যদের সাথে। টেলিভিশনে তখন সংবাদ প্রচার হচ্ছে। সংবাদের প্রতি কারো আগ্রহ নেই। কি হব এত খবর জেনে?
এই অনাগ্রহ টা বেশিক্ষণ স্থায়ি হয় না। সংবাদ পাঠিকা কুড়িগ্রাম নাম মুখে আনতেই সবাই টেলিভিশনে তাকায়।কুড়িগ্রামের ধরলা ব্রিজের উত্তরে কলা বাগানে দুুটো ছেলে মেয়ের নগ্ন লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ছেলেটার পরিচয় শনাক্ত করা গেছে, নাম নিলয় তালুকদার। বয়স বাইশ। ধারনা করা হচ্ছে যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিকারক মাত্রাতিরিক্ত বা মেয়াদ উত্তীর্ণ ট্যাবলেট সেবনে মৃর্ত্যু ঘটেছে তাদের ।
প্রথমে চমকে ওঠে অহনা। শুকরিয়া, সে ভুল হতে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল।
ট্যাবলেট এর প্রতিক্রিয়ায় মৃর্ত্যু - পুলিশী ধারনা হলেও ; শিকারীই যে শিকার হয়েছে তা ভাবতে অহনার একটুও কষ্টবোধ হয় না।
লেখা: নুর আলম সিদ্দিক
Comments (0)